প্রতিদিন ভর্তি হয় ১৯০২ রোগী

শেবাচিমে প্রতিদিন ২০ রোগীর মৃত্যু

জানুয়ারি ২৮ ২০২৫, ১৮:৪৭

ফাহিম ফিরোজ ॥ দক্ষিণ জনপদের কোটি মানুষের চিকিৎসা সেবার অন্যতম স্থান বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। নানা সংকটের পরেও লাখ লাখ মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালটি। হাসপাতালটি বর্তমানে দেড় হাজার শয্যা বিশিষ্ট। তবে হাসপাতালটিতে চিকিৎসক কর্মকর্তা কর্মচারী ও বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি সহ নানা সংকটে রয়েছে। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হাসপাতালটিতে প্রতিদিন ৩৯৯২ জন সেবা প্রার্থী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এরমধ্যে প্রতিদিন ২০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে এসে মৃত্যুবরণ করেন।

জানা গেছে, বিভাগের ছয়টি জেলা হাসপাতালের চারটিকে ১০০ থেকে আড়াই শ শয্যায় উন্নীত করে বড় বড় অবকাঠামো ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক টেকনোলজিস্ট, কর্মচারী-সংকটে সেখানে কার্যত চিকিৎসাসেবা বলতে কিছু নেই। সেখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে যাঁদের অবস্থা একটু গুরুতর, তাঁদের রেফার করা হয় বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মূমুর্ষ সেই রোগীদের বড় একটা অংশ মারা যাচ্ছেন।

পাশাপাশি বিভাগের ৪২টি উপজেলার মধ্যে ৪০টিতে যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে, সেসব চিকিৎসাকেন্দ্রে মূলত চিকিৎসাসেবা কার্যত নামে আছে, বাস্তবে নেই। সেখান থেকেও মুমুর্ষ রোগীতে পাঠানো হয়, শেবাচিমে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে তাদের অধিকাংশের মৃত্যু ঘটে। জেলা এবং উপজেলা পর্যায় থেকে সাধারনত জটিল ও খারাপ রোগী শেবাচিমে আসেন। তাই এখানে মৃত্যুর হারও বেশি। শেবাচিম থেকে সরবরাহকৃত এই প্রতিবেদনে রোগের ধরন, মৃত্যুর কারণ উল্লেখ নেই। বয়স কিংবা জেন্ডার ভিত্তিক পরিসংখ্যানও নেই।

হাসপাতাল প্রশাসন জানায়, এ হাসপাতালে অন্তর্বিভাগে ১৭টি এবং ১৭টি বহির্বিভাগ ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বহির্বিভাগ নতুন চারটি ও অন্তর্বিভাগে তিনটি বিভাগ যুক্ত হয়েছে। এখন অন্তর্বিভাগে ২০টি, বহির্বিভাগ ২১টি ইউনিট রয়েছে। নতুন চারটি বহির্বিভাগ হচ্ছে ভাসকুলার সার্জারি, কার্ডিওলজি, ইউরোলজি ও গ্যাস্ট্রোলজি। এছাড়া তিনটি অন্তর্বিভাগ হচ্ছে নিউরোলজি, ডায়াবেটিক ও বার্ন ইউনিট। আরো আছো জরুরী বিভাগ।

শেবাচিম হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০২৪ সালে ১৪ লাখ ৫৭ হাজার ৩৬২ জন সেবা প্রার্থী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে আন্ত বিভাগে ভর্তি ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩৬ জন, বহি:বিভাগে ভর্তি ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭ জন, জরুরী বিভাগে ২ লাখ ৪ হাজার ৭৬৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এই সময়ে ৭ হাজার ১৩৭ জন চিকিৎসা নিতে এসে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই হিসেবে প্রতিদিন মারা যায় ২০ জন রোগী। অপরটিকে প্রতিদিন ১ হাজার ৯০২ জন রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রতিদিন নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে আড়াই হাজারের উপরে রোগী ভর্তি থাকে হাসপাতালটিতে।

হাসপাতাল সূত্র আরো জানায়, হাসপাতালটিতে ২২৪ জন চিকিৎসকের পদ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে হাসপাতালটিতে ২০৫ জন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি সেবা প্রার্থীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন তারা। ফলে হাসপাতালটিতে চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতিরও সংকট বিদ্যমান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ১৩ হাজার ২৮২ জন রোগীকে মেজর সার্জারি চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ২০ হাজার ১৫৯ জন রোগীকে মাইনর সার্জারি চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। সেই হিসেবে প্রতিদিন ৯২ জন রোগীকে সার্জারি চিকিৎসা দেয়া হয়।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে ৭২১, ফেব্রুয়ারিতে ৬১৯, মার্চে ১১৬, এপ্রিলে ৫৬৮, মে মাসে ৫৮৪, জুনে ৫২৪, জুলাইতে ৫১৪, আগস্টে ৫৪৫, সেপ্টেম্বরে ৫৭০, অক্টোবরে ৫৫৮, নভেম্বরে ৬৪৫ ও ডিসেম্বরে ৬৭৩ জন মৃত্যু বরণ করেন। তবে কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৩টি বিষয়কে দুর্ঘটনা, আঘাত বা জখমের মধ্যে ফেলেছে। এগুলো হচ্ছে আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা, পড়ে যাওয়া, ধারালো বস্তু দ্বারা কেটে যাওয়া, পড়ন্ত বস্তুর আঘাতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া পুড়ে যাওয়া, প্রাণী ও কীটপতঙ্গের কামড় ও আঘাত, সহিংসতা, পানিতে ডোবা, মেশিন বা যন্ত্রপাতির আঘাত, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, দুর্ঘটনাজনিত শ্বাসরোধ ও দুর্ঘটনাজনিত বিষপানে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ডেঙ্গুর পাশাপাশি অপরিনত বয়সের শিশু মৃত্যুর বিষয়টিও রয়েছে। আছে মাতৃ মৃত্যুর মতো ঘটনাও।

উপ-পরিচালক ডাক্তার এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, হাসপাতালটিতে ৫০০ শয্যার ২২৪ জনবলের চিকিৎসকের পদ রয়েছে। ওই পদের বিপরীতে ২০৫ জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। তারা এক হাজার ৩০০ শিক্ষার্থীকে পাঠদানের পাশাপাশি সেবা প্রার্থীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। হাসপাতালটিতে চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতিরও সংকট বিদ্যমান।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডাক্তার শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ছয় জেলায় সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৩৮২টি। এর মধ্যে ছয়টি জেনারেল হাসপাতাল, ৪০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৭০টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ২৬৬টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এসব হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ ১ হাজার ২৮১টি। সেখানে প্রায় অর্ধেক চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। যাদের অনেকেই আবার ডেপুটেশনে রয়েছেন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের।