দিনে মাছ, রাতে পিঠা বিক্রি করেন শরীফ

পিরোজপুর প্রতিনিধি !! ঘড়িতে রাত ১১টা বেজে ৪০ মিনিট। কনকনে ঠান্ডায় শরীফ ইসলাম (৩০) তিনটি মাটির চুলায় চিতই পিঠা বানাচ্ছেন। আর ফাঁকে ফাঁকে এগুলো দিচ্ছেন সামনে বসে থাকা ক্রেতাদের হাতে। পিঠার সঙ্গে বিনা মূল্যে আছে কাঁচা মরিচ ও চিংড়িমাছের ভর্তা। পিঠার দাম পাঁচ টাকা।
শরীফের অস্থায়ী পিঠার দোকান পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার পিরোজপুর-পাথরঘাটা সড়কের চরখালী ফেরিঘাটে। তিনি সন্ধ্যায় পিঠা তৈরি শুরু করেন। রাত প্রায় ৩টা পর্যন্ত চলে এসব পিঠার বেচা-কেনা। ঘাটের কাছে তাঁর বাড়ি। দিনে তিনি নদীতে মাছ ধরেন। বাড়তি আয়ের জন্য রাতে পিঠা বিক্রি করেন।
বুধবার রাতে ফেরিঘাটে কথা হয় শরীফের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিদিন ১০ কেজি চালের গুঁড়ার চিতই পিঠা বিক্রি করেন। এতে তিন হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়। খরচ বাদে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা লাভ থাকে।
পিঠা বানানোর ব্যস্ততার মধ্যেই কথা বলছিলেন শরীফ। তিনি বলেন, বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান রেখে রাতে কিছু আয়ের আশায় এই ঠান্ডায় বসে কষ্ট করেন। বিকেলে মেশিনে চাল গুঁড়া করেন। এরপর বাড়ি থেকেই আনেন গরম পানি। এসব পিঠা বিক্রি করতে কোনো দিন ১২টাও বেজে যায়, আবার কোনো দিন রাত ৩টাও ছাড়ায়। যেদিন কুয়াশায় ঘাটের ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে, সেদিন আগেই পিঠা বিক্রি হয়। অন্যদিকে যে দিন ফেরি চলাচল স্বাভাবিক থাকে, সেদিন একটু দেরিতে পিঠা বিক্রি শেষ হয়।
শরীফ বলেন, ‘আমার কাছে যারা চিতই পিঠা খায়, তাগো অধিকাংশ রাতে চলাচল ট্রাকের চালক ও হেল্পার (চালকের সহকারী)। তাঁরা পাথরঘাটা থেকে মাছ নিয়ে নানা জায়গায় যাওয়ার সময় এই ঘাটে দাঁড়ান। আমি তাগো জন্যই চালের গুঁড়ার সঙ্গে কোনো আটা-ময়দা মিলাই না। অনেকে আছে ময়দা দিয়ে পিঠা বানায়—এগ্লা খাইতে ভালো লাগে না। আমার কাছে যে পিঠা খায়, একবারে ৮–১০টার কমে কেউ খায় না। আমি পিঠার সঙ্গে আপানোগো ভাবির বাটা কাঁচামরিচ আর চিংড়ি ভর্তা ফ্রি দিই। খালি পিঠা তো আর খাওন যায় না। ভালো আছি এহন। দিনে মাছ বেচি আর রাইতে হাজারখানেক টাকা থাকে। কোনো ঘর ভাড়া নাই, কোনো সহকারী নাই; নিজেই সব করি।’
পাশে বসে পিঠা খাচ্ছিলেন ট্রাকচালক আবদুস সালাম। তিনি বলেন, প্রতিদিন রাতে পাথরঘাটা দিয়ে আসার সময় তো এসেই ফেরি পান না। তখন ঘাটে কোনো দোকান খোলা থাকে না। শুধু এই পিঠার দোকানই খোলা পান।
কথার একপর্যায়ে আফসোস করছিলেন চালক আবদুল সালাম। বলছিলেন, ‘আমরা তো আর বাড়ির পিঠা খাইতে পারি না, তাই ওর কাছে সবাই পিঠা খাইয়া সময় কাটাই। আর নদীর ওপারে তাকাই কখন ফেরি আহে। একখান পিঠা নেয় পাঁচ টাকা আর সঙ্গে একটু ভর্তা দেয়। খাইতে ভালোই লাগে।’
আলম নামের এক ট্রলার চালক বলেন, ‘রাইতে ট্রলার চালাই। এপার-ওপার যাই। অবসরে ওর (শরীফ) দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া সময় দিই আর পিঠা খাই। ওর পিঠা গরম-গরম খাইতে ভালো লাগে।’