নোনা জলে সোনা ফলছে
লবনাক্ত জমিতে ফসলের সমারোহ

Copy of Green Farmer Story Presentation - 2
স্টাফ রিপোর্টার : দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। পিঠাপিঠি ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলীয় এলাকার কৃষি ও জনজীবন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিজ্ঞানীরা। বরিশাল বিভাগে ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৩০ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমি অতি লবণাক্ত (নোনা) ছিল। যা বছরের অধিকাংশ সময়ই কৃষি কাজের বাইরে পতিত ছিল।
কারণ কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে উপকূল এলাকায় ঘন ঘন দুর্যোগের কারণেই লবণাক্ত হওয়ার ছবিটার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। কারণ কয়েক বছর ধরে বৃষ্টিপাত কম হওয়া, উজানের পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় উপকূলের নদ-নদীতে উজানের প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভয়াবহ লবণাক্ততা ছড়িয়েছে। সেই নোনা জলেই সোনা ফলিয়েছেন কৃষকরা। ইতোমধ্যেই তারা নোনা জলের পরিত্যাক্ত জমিতে গম, ডাল পাট, সূর্ষমুখী আবাদ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) মাটি ও পানির প্রথম জরিপ চালায় ১৯৭৩ সালে। ওই জরিপে দেখা যায়, উপকূলীয় ১৮টি জেলায় ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ত। প্রথম জরিপের ২৭ বছর পর ২০০০ সালে দ্বিতীয় পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে দেখা যায়, লবণাক্ত জমি বেড়ে হয় ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ হেক্টর।
২০০৯ সালের তৃতীয় জরিপে লবণাক্ত জমি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টরে। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৩৬ বছরে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। সর্বশেষ ২০০৯ সালে করা জরিপে, বরিশাল বিভাগে ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৩০ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমি অতিলবণাক্ত ছিল। এসব জমিতে লবণের পরিমাণ সময় বিশেষে ১৬ থেকে ২৮ দশমিক ৫ ডেসিসিমেন পার মিটার (ডিএস/এম) পর্যন্ত। তবে চাষাবাদের জমিতে লবণসহনশীলতার সর্বো”চ মাত্রা ৪ থেকে ৮ ডিএস/এম।
২০০৯ সালের ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল অঞ্চলে লবণাক্ততার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল বরগুনা। এ জেলার ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৮০ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ৯৫ হাজার ৬২০ হেক্টর জমি লবণাক্ত। এর পরের অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী। এ জেলার ৩ লাখ ৭ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমির মধ্যে ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৮০ হেক্টর জমি লবণাক্ত। এরপর পর্যায়ক্রমে ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি জেলা ছিল। ২০২০ সালে চতুর্থ জরিপ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে তা হয়নি।
বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আলিমুর রহমান বলেন, কয়েক বছর আগেও বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলার মাটি ও পানিতে বেশি লবণাক্ততা ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে বরিশালের মাটি ও পানিতেও লবণাক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। একবার কোনো জমি লবণাক্ত হয়ে পড়লে তা যত ব্যবস্থাপনা করা হোক না কেন তা আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। তাই লবন সহিষ্ণু জাত চাষাবাদের মাধ্যমে জমির ব্যবহার করতে হয়।
বরিশাল আঞ্চলিক মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এফ এম মামুন বলেন, এ অঞ্চলের মাটি এবং নদ-নদীর পানিতেই নয়। ভূগর্ভস্থ জলের আধারেও মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার উপস্তিত পাওয়া গেছে। বরগুনা ও পটুয়াখালী দুই জেলায় সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি লবণাক্ততার উপস্তিতি পাওয়া গেছে ভূগস্থ’ ও নদ-নদীর পানির উৎসে। যদিও পানির সহনীয় লবণাক্ততার মাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিএস/এম।
উপকূল অঞ্চলে শুধু বৃষ্টির মৌসুমে বছরে একটি মাত্র ফসল, আমন ধান হতো। ২০০৭ সালের সিডরের আগে উপকূলজুড়ে একফসলি জমি ছিল। এই ধান কৃষকেরা ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কেটে ঘরে তোলেন। এরপর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অপঘাতে শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে পতিত থাকতো। এছাড়াও সেচযোগ্য পানির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৪ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সাত মাস কোনো ফসল ফলানো সম্ভব হয় না।
এই বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলের লবণাক্ত পতিত জমিতে ফসল ফলানোর লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ উদ্যোগ গ্রহন করে। তাদের সহায়তায় ২০১৭ সাল থেকে এসব জমিতে বাড়তি ফসল উৎপাদন করা যায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন একদল গবেষক। গমজাতীয় ফসলে অল্প পানি সেচ দিয়েই ভালো ফসল উৎপাদন সম্ভব বলে তারা নিশ্চিত হন। কারণ ফসল হিসেবে গম প্রকৃতিগতভাবেই কিছুটা লবণসহিষ্ণু। তাই রিলে পদ্ধতিতে গম ও মুগ ফসলের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন গবেষকেরা।
বরিশাল বিভাগের চার জেলায় লবণাক্ত জমিতে পাটের বিকল্প হিসেবে আঁশজাতীয় ফসল ‘কেনাফ’ নতুন আশা জাগাচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন এই ফসলের আবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই)। পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা ও পিরোজপুরের প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর লবণাক্ত জমি বছরের অধিকাংশ সময় পতিত থাকে। এই জমিকে বহু ফসলি করার লক্ষ্যে কেনাফ আবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ইনস্টিটিউট সূত্রে আরও জানা গেছে, কেনাফের উৎস আফ্রিকায়। হুবহু পাটের মতোই, তবে পাট নয়। পাটের চেয়ে ফলন বেশি। লবণাক্ততা, খরা এবং অনাবৃষ্টি মোকাবিলা করেই কেনাফ বেড়ে উঠতে পারে। এর ফলে এটি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বপন উপযোগী। কেনাফের ক্ষেত্রে পাটের চেয়ে নিড়ানি ও পরিচর্যা কম লাগে। এটির রোগবালাই প্রতিরোধক্ষমতাও বেশি।
পটুয়াখালীর পাট গবেষণা উপকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ আফলাতুন কবির বলেন, তাদের উদ্ভাবিত জাতগুলোর মাধ্যমে উপকূলীয় প্রায় ১০ লাখ হেক্টর অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনা সম্ভব। কেনাফের আবাদ সম্প্রসারিত হলে পতিত জমি চাষের আওতায় আসবে বলে মনে করেন তিনি।