জেলেদের বাতিঘর, ভরসার আশ্রয়স্থল

জানুয়ারি ২২ ২০২৫, ১৮:৪৬

স্টাফ রিপোর্টার !! গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে বঙ্গোপসাগরে ইলিশের দেখা মেলে। আর ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি মানে বিরূপ আবহাওয়া। কখনো কখনো ইলিশ শিকার করতে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হন জেলেরা। বিশেষ করে রাতে তীর খুঁজে না পেয়ে দিকভ্রান্ত জেলেরা বিপদে পড়েন।

ঝড় ও ঢেউয়ে ঘটে ট্রলার ডুবি। এতে প্রাণ যায় অনেক জেলের। কারণ দুর্গম নদী ও সাগরের মাইলের পর মাইল কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। নেই তীরে কোনো সিগন্যাল বাতি।

যা দেখে জেলেরা তীরে দিকে ছুটতে পারেন। ফলে ঝড় ও ঢেউয়ের কবলে পড়া জেলেরা নিরাপদে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই। দুর্যোগে জেলেদের প্রাণহানি কমানো, নিরাপদ আশ্রয়, মাছ ধরার ফাঁকে বিশ্রামের বিষয়টি চিন্তা করে জেলেদের জন্য ‘লাইট হাউজ’ (আশ্রয়স্থল) নির্মাণ করা হয়েছে। পাকা এই স্থাপনার পাশাপাশি উঁচু টাওয়ার রয়েছে।

প্রায় ছয় তলা ভবনের সমান উঁচু টাওয়ারের সিগন্যাল বাতি অন্তত ৩৫ কিলোমিটার দূর থেকে জেলেরা দেখতে পাবেন। লাইট হাউজ শুধু জেলেদের বাতিঘর নয়, ভরসার আশ্রয়স্থলও। স্থানীয় জেলেরা বলেন, উদ্যোগটি খুব ভালো। ঝড়ো হাওয়া শুরুর আগেই তারা সিগন্যাল দেখে তীরে ছুটে আসতে পারবেন। এতে তারা উপকৃত হবেন।

সাগর-নদীর মোহনায় এ রকম আরো অনেক আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা দরকার বলে তারা মত দেন। বঙ্গোপসাগর তীরের তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদী মোহনায় নির্মিত এ বিশ্রামাগার ও লাইট হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে। তিন নদীর মোহনায় দি শেয়ার ট্রাস্টের অর্থায়নে এবং স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশের টেকনিক্যাল সহযোগিতায় সিবিডিপি এই বিশ্রামাগার ও লাইট হাউসটি বাস্তবায়ন করে। এ ছাড়া প্রকল্পটির সার্বিক সহযোগিতা করে জাগোনারী, ঈশানা নারী ফাউন্ডেশন এবং আরএসডিও।

আশ্রয়কেন্দ্রটি ভূমি থেকে প্রায় ৫ ফুট উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে। ১৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর ১৭ ফুট প্রস্থের আশ্রয়কেন্দ্রটির মেঝেতে বসার জন্য বেঞ্চ রয়েছে। তার পাশেই প্রায় ৫০ ফুট উঁচু টাওয়ার রয়েছে। টাওয়ারের শীর্ষে সিগন্যাল বাতি রয়েছে। টাওয়ারে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। শনিবার (১৮ জানুয়ারি) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নির্মিত এ বিশ্রামাগার ও লাইট হাউজের উদ্বোধন করা হয়।

তিন নদীর মোহনায় যে স্থানে এই আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে সেটির আশপাশে কোনো বাড়িঘর, অন্য কোনো স্থাপনা ও গাছগাছালি নেই। জেলেরা সমস্যায় পড়লে আশ্রয় নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। ঝড়ের রাতে জেলে ট্রলারের জন্য টাওয়ারে একটি লাল বাতির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এই বাতি সাগরতীরের জেলেদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ দিতে পথনির্দেশকের মতো কাজ করবে।

পায়রা নদী ইলিশ রক্ষা কমিটির সভাপতি শাহাজান শেখ বলেন, ‘ইলিশ মৌসুমে ঝড় হয়। হঠাৎ ঝড়ে আমরা পথ ভুলে যাই। কারণ রাতে আশপাশে কোনো সিগন্যাল বাতি থাকে না। তখন যাওয়ার জায়গা থাকে না। এখন সিগন্যাল বাতি দেখে তীরে ফেরা যাবে। পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্র ভরসার স্থাল হবে।’

পায়রা তীরের জেলে বাবুল মিয়া বলেন, ভাদ্র মাসে নদী উত্তাল থাকে। বিপদের সময় তীরে ফিরতে পারলেও মাথা গোজার জায়গা ছিল না। এখন তো যাওয়ার একটা জায়গা হয়েছে। জাল ফেলে একটু বিশ্রামও নেওয়া যাবে।

পরিবেশ সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) তালতলী উপজেলার সমন্বয়ক আরিফুর রহমান বলেন, জেলেদের বিশ্রামাগারে বিশুদ্ধ পানির পাশাপাশি সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন করা হবে। যাতে জেলেরা জীবন রক্ষার পাশাপাশি আশ্রয় নিতে পারেন। শুধু বিপদের সময় নয়, নদীতে জাল ফেলে অনেকে এখানে এসে বিশ্রাম নিতে পারবেন।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাগোনারীর প্রধান নির্বাহী হোসনে আরা হাসি বলেন, ‘জেলেদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দুর্যোগের সময় তারা দিক হারিয়ে ফেলেন। তীরে কোনো আলো না থাকায় তাদের নিরাপদে ফেরার সুযোগ থাকে না। তীর খুঁজতে গিয়ে ঝড়ের মুখে পড়েন। ততক্ষণে হয়ত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। লাইট হাউজ কাম আশ্রয়কেন্দ্রটি করার উদ্দেশ্য হলো বিপদের সময় সিগন্যাল দেখে দ্রুত তীরে ফিরতে পারেন তারা। পাশাপাশি এসব তাদের জন্য একটা ভালো বিশ্রামের জায়গাও হলো।

তালতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালমা বলেন, লাইট হাউসটি নির্মাণের ফলে জেলেরা দ্রুত সময়ে উপকূলে ফিরে আসতে পারবেন। এ ছাড়া লাউট হাউজের সঙ্গে একটি বিশ্রামাগার থাকায় জেলেরা সেখানে এসে বিশ্রাম নিতে পারবেন। জেলেদের সুরক্ষায় ভবিষ্যতে আরো বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।