ঝালকাঠিতে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে প্রতিবন্ধী যুবকের গ্রন্থাগার

ঝালকাঠি প্রতিনিধি : ঝালকাঠি শহরের পুরোনো একটি আবাসিক এলাকা বাকলাই সড়ক। এক সময়ের শান্তিপূর্ণ এই এলাকায় এখন বিভিন্ন বয়সী মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অনেকে নেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। নেশার টাকা সংগ্রহ করতে চুরি-ছিনতাই পর্যন্ত করছেন। এ নিয়ে অভিভাবক ও সচেতন মহলের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এক প্রতিবন্ধী যুবকের উদ্যোগে শুরু হয়েছে সমাজের অন্ধকার দূর করার ভিন্নধর্মী প্রয়াস। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন কবি সুফিয়া কামাল গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা মো. মাহমুদুল হক। তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। পেশায় কম্পিউটার অপারেটর।
জানা গেছে, শৈশব থেকেই মাহমুদুল হকের নেশা বই পড়া। উচ্চশিক্ষা অর্জন না করতে পারলেও নিয়মিত পড়তেন বই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কাজী নজরুল ইসলামের লেখা তিনি বেশি পছন্দ করেন। তাছাড়া তিনি অন্যান্য সাহিত্যিকের লেখাও পড়েন। তার প্রিয় উপন্যাস দেবদাস। বই পড়ার নেশা তাকে অনুপ্রাণিত করেছে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায়। তিনি বিশ্বাস করেন- জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিলে সমাজের অন্ধকার কাটানো সম্ভব। সেই ভাবনা থেকেই ২০১০ সাল থেকে একটি লাইব্রেরি করার স্বপ্ন দেখতেন। সেই থেকে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তিনি হাল ছাড়েননি। অবশেষে ২০১৫ সালে নিজের বাড়ির ছাদে নিজ উদ্যোগে গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু করেন। ২০১৭ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনও পান। বর্তমানে তার গ্রন্থাগার প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে। তার কবি সুফিয়া কামাল গ্রন্থাগারে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ১২০০ বই রয়েছে। বইগুলো মাহমুদুল সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দানশীল ব্যাক্তিদের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছেন।
এই গ্রন্থাগারে প্রতিদিন স্থানীয় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ এসে বই পড়ে, পত্রিকা পড়ে। এই পাঠাগারের আশপাশে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুক্রবার ও শনিবার পাঠকদের এক মিলনমেলা হয় এখানে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই দুই দিন বন্ধ থাকায় উপস্থিতি বেশি হয়। তবে গ্রন্থাগারের কক্ষটি বেশ ছোট হওয়ায় মাঝেমধ্যে পাঠকদের জায়গা সংকুলান হয় না। অবকাঠামো দূর্বল হওয়ায় বৃষ্টিতে পানি পড়ে। পাঠকদের জন্য নেই ভালো বসার ব্যবস্থা। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে এই গ্রন্থাগারটি এলাকার জন্য হয়ে উঠতে পারে আদর্শিক একটি জায়গা। যেখান থেকে মানুষ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে পারে।
ঝালকাঠি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী নাইম হোসেন প্রান্ত বলেন, প্রায় প্রতিদিন বিকেলে আমি এখানে আসি। মাঝেমধ্যে উপন্যাস পড়ি, আড্ডা দিয়ে সময় না কাটিয়ে এখানে এসে বই পড়ি। এখানে আমার পাঠ্য বিষয়ের কিছু বই আছে, যা আমার পড়াশোনায় অনেক উপকারে আসে।
গ্রন্থাগারের একজন নিয়মিত পাঠক ও সংগঠক মো. মজিবুল হক বলেন, আগে আমাদের এলাকায় বই পড়ার জায়গা ছিল না। এখন এখানে এসে পরীক্ষার পড়ার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস পড়ে জ্ঞান বাড়াতে পারছি। এখানে আমরা অনেক ধরনের বই, দৈনিক পত্রিকা পড়তে পারি। চাকরি থেকে অবসরের পর মোবাইলে আসক্ত হয়ে গেছিলাম, এখন এখানে এসে এর থেকে মুক্তি মিলছে। গ্রন্থাগার উন্নয়নের জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে আরও নতুন বই ও আসবাব যোগ করা হবে।
গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হক বলেন, আমি একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। সবার মতো স্বাভাবিক কাজ করতে পারি না। লেখাপড়াও খুব বেশি দূর পর্যন্ত করতে পারিনি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বই পড়তাম বইয়ের প্রতি আলাদা একটা প্রেম আছে। বইয়ের প্রতি প্রেম ও এলাকার তরুণ যুব সমাজের অবক্ষয়ের করুণ চিত্র দেখে গ্রন্থাগার করার চিন্তা মাথায় আসে। আমি গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু করার সময় তেমন কারো সহযোগিতা না পেলেও ধীরে ধীরে সরকারি-বেসরকারি অনেকের সহযোগিতায় এতটুকু আসতে পেরেছি। আমার গ্রন্থাগারে এখন আরও কিছু বই দরকার। গ্রন্থাগারের কক্ষটি আরও বড় করা দরকার। পাঠকরা এখানে এসে ভালো একটি পরিবেশে যাতে বই ও দৈনিক পত্রিকা পড়তে পারে সেজন্য চেয়ার টেবিল প্রয়োজন।
ঝালকাঠি সরকারি মহিলা কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ইমরান হোসেন রবিন বলেন, গ্রন্থাগার শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়লে তারা খারাপ আসক্তি থেকে দূরে থাকবে। এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। শুধু শিক্ষার্থী নয়, সাধারণ মানুষও এই গ্রন্থাগার থেকে উপকৃত হবে। যারা স্কুল–কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পাননি, তারাও এখানে এসে বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন।
ছোট পরিসরে শুরু হলেও কবি সুফিয়া কামাল গ্রন্থাগার এখন ঝালকাঠি শহরের বাকলাই ফাঁড়ির মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে। একজন প্রতিবন্ধী তরুণের এই গ্রন্থাগার শুধু বই পড়ার জায়গা নয়, বরং মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার সম্ভাবনার পথ হয়ে উঠেছে। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সচেতন মানুষ একবাক্যে বলছেন- এটি সমাজের জন্য সত্যিই অনুপ্রেরণার।