শরীরে তাজা গুলি নিয়ে অনিশ্চিত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার : শরীরে তাজা গুলি নিয়ে অনিশ্চিত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ মো. রাব্বি (২৫)। চুড়ান্ত বিজয়ের মাত্র একদিন আগে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন সে। সেই থেকে শরীরে তাজা বুলেটের প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বিনিদ্র রাত কাটে তার। গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এলেও প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর অনিশ্চিত বেঁচে থাকার শঙ্কা নিয়ে মানবেতর দিন পার করছেন রাব্বি।
একদিকে ঋণের বোঝা, সংসারের অনাটন আর ভবিষ্যত চিকিৎসার দুশ্চিন্তা, পেরেশানি কাতর করে তুলেছে তাকে। তেমনি সন্তানের যন্ত্রণাবিদ্ধ কাতরতায় ঘুমতে পারে না পরিবারের সদস্যরা। গুলিবিদ্ধের আট মাস অতিবাহিত হলেও এখনও মেলেনি সরকারি কোনো সহায়তা, খোঁজ নেয়নি সরকারের কোনো দপ্তর। রাব্বি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের বকশিরচর গ্রামের দেলোয়ার হোসেন ও শিউলি বেগমের ছেলে।
লেখাপড়ার খরচ যোগাতে বরিশাল নগরীর একটি চশমার দোকানে চাকরী করেন রাব্বি। ৪ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোডে পুলিশের ছুঁড়া গুলি তাকে আঘাত করে। অত্যাধনিক অস্ত্রের গুলিগুলো তার মাথায় ও মেরুদণ্ডের হাড়ের ডিস্কের মধ্যে বিদ্ধ হয়। এতে তার মাথা ও মেরুদণ্ডের হাড়ের ডিস্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
টানা তিন মাস বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন বাড়িতে অবস্থান করছেন তিনি। আন্দোলনের শুরু থেকেই পড়ালেখা ও কর্মস্থল বন্ধ রেখে ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের সাথে একাত্ম প্রকাশ করে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলো সে। প্রতিদিনের মতো ৪ আগস্ট সকাল বেলা ছাত্র-জনতার সাথে বিক্ষোভরত অবস্থায় রাস্তায় ছিলেন তিনি।
এ সময় বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতার উপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ফ্যাসিস্ট পতিত সরকারের আজ্ঞাবহ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহারকারী বাহিনী। একাধিক গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারায় রাব্বি। আন্দোলনকারী অন্যান্য ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে গোপনে প্রাইভেট চিকিৎসকের নিকট নিয়ে যান। পরবর্তীতে বরিশাল ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে যাবতীয় চিকিৎসা খরচ বহন করতে হয় পরিবারের।
বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে দীর্ঘ চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে গেলেও বর্তমানে প্রায় প্যারালাইসড হয়ে পড়া শরীর নিয়ে কিছুটা হাঁটা চলা করতে পারলেও শরীরে বয়ে বেরানো তাজা বুলেটের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারেন না তিনি। ঘুমাতে পারেন না পরিবারের অন্য সদস্যরাও। দিনরাত তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কাটাতে হচ্ছে রাব্বিকে। সব সময় কাউকে না কাউকে তার পাশে থাকতে হয়। তাই, তার মা, বাবা ও বোন পালাক্রমে পাশে থাকে তার।
পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা থাকতে সমন্বয়করা তার বিস্তারিত তথ্য নিলেও এ পর্যন্ত সরকারি কোনো প্রকার সহযোগিতা পায়নি সে। কোনো দল বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের কেউ কোনো খোঁজ খবর নেয়নি তার। তারা আরও জানান- রাব্বির বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতিতে মাথা ও মেরুদণ্ডের হাড়ের মধ্যে গেঁথে থাকা গুলি অস্ত্রোপচার করে বের করা ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে চিকিৎসকরা।
এ জন্য আরও সময় লাগবে। তবে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারলে হয়ত অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা সম্ভব। কিন্তু একদিকে ধারদেনা, ঋণের বোঝা অন্য দিকে পরিবারের উপার্জনক্ষম ছেলে সম্পূর্ন বেকার। বর্তমানে অভাবের সংসারে দু’বেলা দুমুঠো খাবার জোগান দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে রাব্বির পরিবারের।
রাব্বি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল করে বেড়ানোর জন্য বাবা ও ছেলে দুজনেরই আয়ের পথ বন্ধ রয়েছে। চিকিৎসকদের পরামর্শে বর্তমানে বাড়িতে অবস্থান করছেন রাব্বি। পরিবারে আয়ের এখন কোনো উৎস নেই। আত্মীয়-স্বজন ও বাড়ির লোকজনের সহায়তায় আপাতত চলছে তাদের সংসার।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথের পরেই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা সেবাসহ আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও তাদের কাছে পৌঁছেনি কোনো সহযোগিতা। এমনকি এ পর্যন্ত সরকারের কোনো দপ্তর বা দায়িত্বশীল কেউ খোঁজ খবরও নেয়নি। রাব্বির পিতা দেলোয়ার হোসেন আক্ষেপ করে বলেন – আন্দোলনের শেষের দিকে আমার সন্তান গুলিবিদ্ধ হয়।
ঢাকায় থাকতে সমন্বয়করা এসেছে, নাম ঠিকানা নিয়েছে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভালো চিকিৎসাসহ আর্থিক সহায়তার। ছেলের পিছনে ঋণ করে, গ্রামের মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা তুলে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করেছি। এখন আমি নিঃস্ব রিক্ত। জানিনা আমার ছেলেটার চিকিৎসা শেষ করতে পারবো কিনা।
আহত রাব্বির মা শিউলি বেগম বলেন- আট মাস ঘুমাতে পারি না। রাত পোহালেই এনজিওর কিস্তি, দুবেলা দুমুঠো ভাত জুটবে কিনা এ চিন্তায় থাকি। গ্রামের মানুষ ভাবে আমরা সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি অথচ রাতে খাবো সে চাল ঘরে নাই। আহত রাব্বির ভাই বলেন – আমার ভাই আজ আট মাস গুলিবিদ্ধ, শরীরে তাজা গুলির যন্ত্রণা নিয়ে সারাক্ষণ ছটফট করে। রাতে ঘুমাতে পারেনা।
ভাই হয়ে এ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারিনা। সরকারের নিকট জোর দাবি জানাই, সরকার যেন তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। যাতে সে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়। গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বলেন- আমরা গ্রামবাসী তার চিকিৎসার জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করে দিয়েছি, বর্তমানে তারা খুবই অর্থ সংকটে দিনযাপন করছে। এ বিষয়ে বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জানান- আহত রাব্বির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
কেউ আমাকে কিছু বলেওনি। তার বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব অচিরেই করবো আশা রাখি। এলাকাবাসীর দাবি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সে আহত হয়েছে সরকার যেন দ্রুত তার চিকিৎসা সেবা সহ তার পরিবার যাতে বেঁচে থাকতে পারে তার একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করে।