রুপালি ইলিশের গল্পে জেলেদের শোকগাথা

সেপ্টেম্বর ০৯ ২০২৫, ২১:১০

চরফ্যাশন প্রতিনিধি : নদী বা সাগরে রুপালি ইলিশ আহরণ শুধু অর্থনীতি আর স্বাদের গল্প নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য জেলে পরিবারের কান্না। মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা প্রায়ই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে নিখোঁজ বা নিহত হন। অভিযোগ আছে, নিষেধাজ্ঞা বা বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও তাদের সাগরে পাঠান মালিকরা। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে খোঁজও নেন না। শাহে আলমের স্ত্রীর মতো বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকেন নিখোঁজের স্বজনরা। জানতে পারেন না প্রিয়জন বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন।

জেলে শাহে আলমের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনের নীলকমল ইউনিয়নে। ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। স্বামীর অনুপস্থিতিতে দুই মেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন স্ত্রী নেকু। একটি মেয়ে বিয়ের উপযোগী, অপরজনের পড়ালেখা বন্ধ। হাঁস-মুরগি পালন আর অন্যের বাসায় কাজ করে কোনো রকমে সংসার চলছে। নেকু বলেন, মৎস্য অফিস থেকে একবার কিছু টাকা পেয়েছিলাম, ভাইয়েরাও সাহায্য করেছেন। কিন্তু আর কত সাহায্য করবেন? সরকার যেন আমাদের মতো পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ায়।

জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কবলে পড়ে ৭টি টলার ডুবে যায়। এরমধ্যে ‘নুসরাত’ ট্রলারের ২০ জন ‘শারমিন’র ৮ জন ‘এফবি তিন্নি’র ৬ জন ‘এফবি আম্মাজান’র ১১ জনসহ মোট ৭৮ জেলে নিখোঁজ হন। এরমধ্যে ভারতের কারাগার থেকে দুই দফায় ৩৬ জন জেলে উদ্ধার হন। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ৪২ জন। তাদের বাড়ি চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায়। একই ঝড়ে চরফ্যাশনের মায়া ব্রিজ এলাকার মনির মাঝির ট্রলারটি ২২ মাঝিমাল্লা নিয়ে ডুবে যায়। এরমধ্যে কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ মনির মাঝির স্ত্রী নুসরাত বেগম বলেন, মালিকপক্ষ নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তাদের সাগরে পাঠায়। এমনকি দুর্ঘটনার বিষয়টি প্রকাশ না করার জন্য হুমকি দিয়েছিল। সরকার বা মালিকপক্ষ নিখোঁজদের সন্ধানে কোনো তৎপরতা চালায়নি। অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটালেও কেউ খোঁজ নেয়নি।

মনির মাঝির ট্রলারে ছিলেন চর কলমি ইউনিয়নের নাংলা পাতা গ্রামের তৈয়ব, কবীর ও আবুল কাশেম। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীর অনুপস্থিতিতে তাদের পরিবারেও নেমে এসেছে চরম দুদর্শা। আবুল কাশেমের ভাই মিজান বলেন, মালিকপক্ষের লোভের কারণে আমরা আজ নিঃস্ব। সাগরে গিয়ে প্রাণ গেলে বিচার বা সাহায্য কিছুই পাওয়া যায় না।

চরফ্যাশন উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্য মতে, উপজেলায় প্রায় ৯০ হাজার জেলে রয়েছেন। এরমধ্যে নিবন্ধিত জেলে ৪৪ হাজার ২৮১ জন। এ অঞ্চলে প্রায় ১২ হাজার ট্রলার ও নৌকা রয়েছে। এছাড়া গভীর সমুদ্রগামী ৭ হাজার ট্রলার রয়েছে। ২০১৫ সালে ১১ জন, ২০১৬ সালে ১৯ জন, ২০১৭ সালে ৫ জন, ২০১৯ সালে ৪৮ জন, ২০২০ সালে ৯ জন, ২০২১ সালে ৯ জন, ২০২২ সালে ১২ জন, ২০২৩ সালে ৩৫ জন, ২০২৪ সালে ১১ জন জেলে নদী বা সাগরে নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ বা প্রাণ হারিয়েছেন।

জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারানো জেলে পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২১ এবং ২০২৩ ও ২০২৪ সালে নিখোঁজ জেলেদের পরিবারকেও অনুদান দেওয়া হয়েছে। তবে ২০১৮ ও ২০২২ সালে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারানো জেলেরা সরকারি অনুদান পাননি।

উপজেলা মৎস্য কার্যালয় আরও জানায়, নিহত জেলেরা চর মাদ্রাজ, আসলামপুর, মাদ্রাজ, জিন্নাগড়, আমিনাবাদ, আবুবকরপুর, আহম্মদপুর, ওসমানগঞ্জ, এওয়াজপুর, হাজারীগঞ্জ, জাহানপুর, রসলপুর, চর মনিকা, চর কুকরি মুকরি, চর পাতিলা, নজরুল নগর, মুজিব নগর, ঢালচর, নুরাবাদ, নীলকমল, আব্দুল্লাহপুর, চরকলমী এলাকার। এদের কারো লাশ পাওয়া গেলেও খোঁজ মেলেনি অনেকের। স্থানীয় ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি রফিক মাস্টার বলেন, শাহে আলম সাহসী ও অভিজ্ঞ জেলে ছিলেন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের সময় মালিকরা তাকে মাছ ধরতে পাঠান।

সামরাজ মৎস্যঘাট জেলে সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, উপকূলীয় এলাকার ৯০ শতাংশ বাসিন্দা জেলে। তারা জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যান।

চরফ্যাশন উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু বলেন, নিখোঁজ বা নিহত জেলেদের পরিবারকে নগদ ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি জেলে পরিবারকেও একই হারে অর্থ দেওয়া হবে।