শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘরের মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উধাও

মার্চ ১১ ২০২৫, ১৯:৩৮

স্টাফ রিপোর্টার : ১৯৮৫ সালের ২৭ অক্টোবর। বাড়ির পাশে পুকুর কাটার কাজ চলছিল গোলাম মোস্তফা দুলালের। বেশ কিছুটা গভীরে যাওয়ার পর কোদালের সঙ্গে কিসের যেন আঘাত লেগে হঠাৎ ‘ঠং’ আওয়াজ। এরপর সাবধানে মাটি খুঁড়ে মিলল খাসার পান ধাতবে তৈরি বুদ্ধদেবের মূর্তি। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল শত বছরের পুরোনো। সংরক্ষণের জন্য এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি বরিশালের বানারীপাড়ায় শের-ই-বাংলা জাদুঘরে দান করেন বাবুল। সেখানকার রেজিস্টারেও আছে এটি থাকার তথ্য। কিন্তু বাস্তবে এখানে নেই সেটি। কেবল এই খাসার পানের নিদর্শনই নয়, এ রকম অন্তত আরও ১২টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের খোঁজ মিলছে না এই জাদুঘরের। দায়িত্বশীলরাও এ ব্যাপারে বলছেন না কিছুই।

মোস্তফা দুলাল বলেন, বাড়ির পাশের জাদুঘরে দেশ-বিদেশের লোক এসে এটা দেখবে ভেবেই দান করেছিলাম। কিন্তু আজ তা উধাও। তখন এই জাদুঘরের ইনচার্জ ছিলেন মিজানুর রহমান। তার হাতেই তুলে দিয়েছিলাম নিদর্শনটি। ৩-৪ বছর পর শুনি সেটি নাকি নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকায়। ফ্রান্সের একটি অনুষ্ঠানে প্রদর্শনের জন্য। তারপর তা আর ফিরে আসেনি। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠিও দিয়েছিলাম। উত্তর পাইনি।

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার চাখারে অবস্থিত এই জাদুঘরটির আশপাশের বাসিন্দারা জানান, খাসার পান ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলে মাটির নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া বুদ্ধের ধাতব মূর্তিসহ অন্তত ১২টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই জাদুঘরে জমা করেছিল স্থানীয় লোকজন। জাদুঘরের রেকর্ডপত্রেও আছে সেগুলো এখানে থাকার তথ্য। কিন্তু বাস্তবে এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই এই জাদুঘরে।

বিভিন্ন সূত্র এবং জাদুঘর প্রতিষ্ঠাকালীন রেকর্ডপত্র অনুযায়ী, ১৯৭৮ সালের ৩০ জানুয়ারি চাখারে শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের বসতভিটা পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহিদ জিয়াউর রহমান। সে সময় তিনি ঘোষণা দেন ফজলুল হকের স্মৃতি সংরক্ষণে তার নামে একটি জাদুঘর স্থাপনের। প্রায় ১ একর জমির ওপর ১৯৮২ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হয় এই জাদুঘরের। জমি দেন শের-ই-বাংলার পরিবারের সদস্যরা। ৫ কক্ষবিশিষ্ট জাদুঘরের ৩টিকে করা হয় প্রদর্শনী কক্ষ।

একটি অফিস এবং একটি রাখা হয় আবাসনের জন্য। ১৯৮৩ সালে এখানে জনবল নিয়োগ দেয় মন্ত্রণালয়। ৬টি পদের মধ্যে ১ জন সহকারী পরিচালক, ১ জন উচ্চমান সহকারী, ১ জন অফিস সহকারী, ১ জন মালী, ১ জন নিরাপত্তাকর্মী এবং ১ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। যদিও এই ৬টি পদের ৩টিই বহু বছর ধরে খালি। বর্তমানে এখানে একজন উচ্চমান সহকারীসহ কর্মরত আছেন একজন মালী ও একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ৩ জনই আছেন ডেপুটেশনে। এছাড়া দৈনিক মজুরিতে ৪ পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে দিয়ে কাজ করায় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।

রোববার সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া সপ্তাহে ৬ দিন দর্শনার্থীদের জন্য খোলা রাখা হয় এই জাদুঘর। সোমবার জাদুঘর খোলা থাকে দুপুর ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। বাকি ৪ দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এটি পরিদর্শনের সুযোগ পায় দর্শনার্থীরা। ১০ টাকার প্রবেশ মূল্য দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর জীবদ্দশায় শের-ই-বাংলার ব্যবহৃত নানা আসবাব আর স্মৃতি দেখার সুযোগ পায় তারা।

জাদুঘরের প্রদর্শনীর ৩টি কক্ষে রয়েছে প্রবাদপ্রতিম এই রাজনীতিবিদের পারিবারিক পরিচিতি, রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস, তার নিজ হাতে লেখা চিঠিসহ বিভিন্ন নিদর্শন, তার সংগ্রহের লাইব্রেরির কিছু অংশ, তার ব্যবহৃত পালঙ্ক খাট, ড্রেসিং টেবিল, ইজি চেয়ার, আলনা এবং কুমিরের একটি খোলস। বিভিন্ন সময়ে ওই এলাকায় মাটির নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীও প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে এখানে।

শুক্রবার জাদুঘরটি ঘুরে দেখার সময় কথা হয় কয়েকজন দর্শনার্থীর সঙ্গে। ভোলার লালমোহন থেকে আসা নাছিউর রহমান বলেন, এখানে অযত্ন-অবহেলার ছাপ দেখছি। প্রচারের অভাব আর জাদুঘরটির বেহালের কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন সবাই। আমি এই অঞ্চলের মানুষ হয়েও জানতাম না যে এখানে এ রকম একটি অনন্য নিদর্শনের জাদুঘর আছে। বরিশালে বেড়াতে এসে লোকমুখে শুনে এখানে এসেছি। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ এটির সংস্কারের পাশাপাশি প্রচারের ব্যবস্থা করলে বহু দর্শনার্থী আসবে।

সরেজমিন দেখা যায়, পুরোনো ভবনের ছাদের ছিদ্র দিয়ে সরাসরি সূর্যের আলো এসে পড়ে জাদুঘরের মেঝেতে। পলেস্তারা খসে পড়া দেওয়াল আর দাঁত বের করে হাসতে থাকা ইট বুঝিয়ে দেয়, কতটা অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে জাদুঘরটি।

জাদুঘরের উচ্চমান সহকারী বলরাম দাস বলেন, ভবন সংস্কারে টেন্ডার হয়ে গেছে। খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে। তবে জাদুঘর থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিদর্শন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। ঘটনাগুলো তিনি এখানে আসার আগের বলে এড়িয়ে যান বিষয়টি।