বরিশালের প্রতি এই অবহেলা কেন?

নাছিম উল আলম : বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানা জুড়ে বিস্তীর্ণ জলরাশির মাথায় যে রূপালি উর্মিমালা আলিঙ্গন করছে, বিশ্ব মানচিত্রে তাই বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর অন্য সব সাগরের মতই প্রকৃতির সব লীলার সঙ্গিনী হয়ে মেতে আছে আমাদের অবিচ্ছেদ্য বঙ্গোপসাগরও। তারই কিনারায় প্রকৃতির সব প্রতিকূলতা ও তা-ব সহ্য করে টিকে আছে ‘ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল’। প্রকৃতির সাথে নিরন্তর লড়াই করে টিকে থাকা এ অঞ্চলের কোটি মানুষ তাদের মুখের গ্রাস রক্ষায় বার বারই ঝড়, ঝলোচ্ছ্বাস, প্লাবন, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করেই টিকে আছে বরিশাল। কিন্তু এর অর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সব সরকার অঘোষিত রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করে আসছে। ফলে আমজনতার হতাশা ক্রমে ক্ষোভে পরিণত হচ্ছে।
শুধু টিকে থাকাই নয়, সব প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে দানাদার খাদ্য ফসল, মাছ এবং দুধ, ডিম ও গোশতে উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চল জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। এমনকি আসন্ন ঈদ উল আজহাতে প্রায় ৪ লাখ পশু কোরবানির পরেও আরো অন্তত ৫০ হাজার উদ্বৃত্ত থাকবে বলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে।
সারাদেশের প্রায় ৭০ ভাগ ইলিশের উৎপাদনই হয় বরিশালসহ সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলে। আন্তর্জাতিক পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, একজন মানুষের দৈনন্দিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরিতে আমাদের দেশে তা ইতোমধ্যে ৬২.৫৮ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে এহার আরো বেশি বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৮ এর হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট জিডিপির ৩.৫৭% এবং কৃষিজ জিডিপির ২৫.৩০% মৎস্যখাতের অবদান। ২০১৬-১৭ সালে দেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও দক্ষিণাঞ্চল আরো ৫ বছর আগেই এখাতে সয়ম্ভরতা অর্জন করে।
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে মাছের উৎপাদন প্রায় ৭৫% বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ টন চাহিদার বিপরিতে এখন প্রায় ৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১১২%। কিন্তু সারা দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে তেমন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেই। আজ পর্যন্ত এ অঞ্চলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ নিয়ে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে ইলিশ গবেষণার কোনো প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নেই।
১৯৯৫ সালের ৮ নভেম্বর ভোলার সাহবাজপুরে প্রথম ‘অ্যাপ্রাইজাল কূপ’ খনন করে গ্যাস আবিষ্কারের প্রায় ৩০ বছর পরেও তা জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হয়নি। ইতোমধ্যে ভোলায় খননকৃত ৯টি কূপের সবগুলোতেই গ্যাসের মজুত মিলেছে। সেটা সারা বিশে^ বিরল। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি-বাপেক্স’র দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, সারাদেশে বর্তমানে আবিষ্কৃত-মজুত ১৬ টিসিএফ গ্যাসের মধ্যে ভোলাতেই আবিষ্কৃত মজুত গ্যাসের পরিমাণ ২ টিসিএফ। সে নিরিখে দেশের আবিষ্কৃত মজুত গ্যাসের ৮/২ ভাগই ভোলাতে মজুত রয়েছে। কিন্তু গত ৩০ বছরেও সে গ্যাস দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্যে জোটেনি। দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের অর্থনীতির উন্নয়নেও ভোলার গ্যাস কোনো অবদান রাখেনি। তবে ভোলার প্রাকৃতিক গ্যাস সিএনজি আকারে সড়কপথে পরিবহন করে ঢাকা নিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবারহ করা হচ্ছে।
গত অর্থবছরেও চাল ও গমে ১২ লাক্ষাধিক টন উদ্বৃত্ত ছিল দক্ষিণাঞ্চল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় ১ কোটি জনসংখ্যার বরিশালে গত অর্থ বছরে চাল ও গমের উৎপাদন ছিল ৩২ লাখ টনেরও বেশি। আন্তর্জতিক মানদ- অনুযায়ী এ অঞ্চলে চাল-গমের চাহিদা ১৬ লাখ ৭০ হাজার টনেরও কম। এর সাথে বীজ বাদ দেয়ার পরেও উদ্বৃত্তের পরিমাণ ১২ লক্ষাধিক টন বলে জানা গেছে।
সদ্যসমাপ্ত রবি মৌসুমে বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চলে সবজি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৮ লাখ টন। এ অঞ্চলে সবজি এখন বিশে^র বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বিগত খরিপ-২ মৌসুমে বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ২৪ লাখ টন আমন এবং সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুমে প্রায় ১৮ লাখ টন বোরো চাল উৎপাদন হয়েছে। এবার দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে গম উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ টনের কাছে। এছাড়া তরমুজ, পেঁয়াজ, গোল আলু, মুগডাল, খেশারী ডাল ও মিষ্টি আলু উৎপাদনে দক্ষিণাঞ্চলের অবদান অপরিসীম। সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে সারাদেশে উৎপাদিত প্রায় ৪০ লাখ টন পেঁয়াজের অন্তত ৩০ লাখ টন পাওয়া গেছে বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চল থেকে। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের তরমুজ সারাদেশে সমাদৃত। সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুমেও দেশের তরমুজের প্রায় ৮০ ভাগেরই উৎপাদন ছিল বরিশালে।
কিন্তু এতসব কিছুর পরেও নানামুখী বঞ্চনা ঘিরে আছে দক্ষিণাঞ্চলকে। আজো রাজধানীসহ সারাদেশের সাথে দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অতি সম্প্রতি পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বরিশালে এক মতবিনিময় সভায় জানিয়েছেন, ‘ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু পার হয়ে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দে ভাংগায় এসে পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা যেন ভেঙে পড়েছে’। মূলত প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পদ্মাসেতু ও সংযুক্ত এক্সপ্রেসওয়ে ভাংগায় এসে শেষ হলেও এর পরে বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা ও যশোরসহ বেনাপোলমুখী মহাসড়কগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। সবচেয়ে করুণ অবস্থা বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত দেশের ৮ নম্বর জাতীয় মহাসড়কটির। মাত্র ১৮-২৪ ফুট প্রশস্ত এ মহাসড়কটি ধরে ভাংগা থেকে ৯১ কিলোমিটার দক্ষিণে বরিশাল পৌঁছতেই এখন সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টাও সময় লাগছে। বরিশাল থেকে ১০৮ কিলোমিটার দক্ষিণে সাগর পাড়ের কুয়াকাটামুখী মহাসড়কটির অবস্থা আরো করুণ।
ফরিদপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়কটি ৬ লেনে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে ২০১৫ থেকে ’১৮ সালের মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও পথনকশা প্রণয়নসহ প্রকল্প-সারপত্র তৈরি হলেও তার আলোকে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি এ মহাসড়কটি উন্নয়নে ভূমি হুকুম দখলে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১,৮৬৭ কোটি টাকার একটি আলাদা প্রকল্প অনুমোদন প্রদান করা হলেও ২০২১-এর জুনের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য সে ভূমি অধিগ্রহণ কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফলে এখাতেই ব্যায় প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে। অতি সম্প্রতি আগের ব্যয়-বরাদ্দ ঠিক রেখেই কুয়াকাটার পরিবর্তে লেবুখালী পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে আগামী বছরের জুনের মধ্যে তা সম্পন্ন করার নির্দেশনা দিয়ে প্রথম সংশোধনী অনুমোদন করেছে একনেক। তবে সে প্রকল্পে বরিশাল বাইপাস বাদ দেয়া হয়েছে।
ভারতবর্ষে রেল যোগাযোগ চালুর দু’ শতাধিক বছর পরেও বরিশালে রেল লাইন প্রবেশ করনি। বৃটিশ যুগে এলক্ষ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও পথনকশা প্রণয়ন করা হলেও সে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। ১৯৬৬ সালের পরে ফরিদপুর থেকে বরিশাল পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। স্বাধীনতার পরে ফরিদপুর প্রান্ত থেকে কাজ শুরু করে পুকুরিয়া পর্যন্ত রেল লাইন চালু এবং ভাংগা পর্যন্ত মাটির কাজ সম্পন্ন হলেও এরশাদ সরকার ক্ষমতা দখলের পরে পুরো প্রকল্পটি বাতিল করে ভূমি মালিকদের জমি ফেরত দেয়া হয়। পদ্মাসেতু চালু এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর চালু হবার পরে নতুন করে রেল লাইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। এরই আলোকে সরকার এ লক্ষ্যে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দেশীয় তহবিলে ভাংগা জংশন থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর/কুয়াকাটা পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষাসহ পথনকশা প্রণয়ন ও ডিপিপি প্রস্তুত করে। প্রায় ২১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ রেললাইনের জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। সৌদি আরব ও চীন প্রকল্পটির জন্য আগ্রহ দেখালেও বিষয়টি আর চূড়ান্ত হয়নি। প্রকল্পটির ওপর সারাদেশের সাথে বরিশাল বিভাগীয় সদর এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর ছাড়াও কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রসহ মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ঝালকাঠী ও পটুয়াখালী জেলার রেল সংযোগ নির্ভরশীল।
দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘ দাবি ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে বরিশাল বিমান বন্দর নির্মাণ শেষে ১৯৯৫ সালের ৩ ডিসেম্বর জাতীয় পতাকাবাহী বিমান ফ্লাইট চালু করা হয়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, পদ্মাসেতু চালু হবার পরে নানা খোঁড়াযুক্তি হাজির করে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট থেকে বরিশালে বিমানের দৈনিক ফ্লাইট সপ্তাহে তিন দিনে হ্রাস করা হয়েছে। তিনদিনও এমন সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা যাত্রীদের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের অভ্যন্তরীণ সেক্টরগুলোর মধ্যে বরিশালের যাত্রীভাড়া সবচেয়ে বেশি। ঢাকা থেকে সৈয়দপুরের দূরত্ব ১৪৬ অ্যারোনটিক্যাল মাইল। আর ঢাকা থেকে বরিশাল আকাশ পথে দূরত্ব মাত্র ৬১ অ্যারোনটিক্যাল মাইল। কিন্তু বরিশাল সেক্টরে আকাশ পথে ভাড়া প্রতি নটিক্যাল মাইলে প্রায় ৬০ টাকা। আর সৈয়দপুরে তা মাত্র ৩৬ টাকা।
লেখক: দৈনিক ইনকিলাব, বরিশাল।