৬৫ লাখ টাকা আত্মসাত করে শিক্ষক দম্পতি উধাও

মে ১১ ২০২৫, ০৩:৪৭

ফাহিম ফিরোজ॥ যোগ্যতা নেই তবুও ক্ষমতার প্রভাবে হয়েছিলেন অধ্যক্ষ। সেই ক্ষমতা বলেই আত্মসাত করেছেন ৬৫ লাখ টাকা। তাইতো বাঁচার জন্য সরকারের পট পরির্বতনের সাথে সাথে পেনশনের টাকা না নিয়েই পারি জমিয়েছেন আমেরিকায়। সেখানে করেছেন বাড়ি। নিয়েছেন গ্রীণ কার্ড। বলছিলাম বরিশাল সিটি কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুজিত কুমার দেবনাথের কথা। তার স্ত্রীর খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া গেলো আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। তিনি কাউনিয়া আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক রীনা রানী সুতার। গত জানুয়ারী মাস থেকে শিক্ষক রীনা রানী সুতার ওই কলেজে অনুপস্তিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বামী স্ত্রী দুজনেই পাড়ি জমিয়েছেন লন্ডনে। সুজিত কুমার দেবনাথ সিটি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল-৪ আসনের সাবেক এমপি পঙ্কজ দেবনাথের আত্মীয় পরিচয়ের প্রভাবে যোগ্যতা না থাকা স্বত্ত্বেও ২০১৫ সালে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। সুসম্পর্ক ছিলো আওয়ামীলীগের সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম, সাবেক এমপি জেবুন্নেছা আফরোজ, সাবেক বিসিসি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লার সাথেও। কলেজের জেষ্ঠ্য শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ লাভ করে সুজিত দেবনাথ। নিয়োগ পেয়ে শুরু করেন অনিয়ম-দুর্নীতি। তার সময়ে কলেজটি দুর্নীতির আতুর ঘরে রূপ নেয়।

যেটা অডিট রিপোর্টে উঠে এসেছে। চার সদস্য বিশিষ্ট অডিট কমিটি গত ৪ ফেব্রুয়ারী রিপোর্ট প্রদান করেছেন। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী সুজিত কুমার দেবনাথ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থাকার সময় ৬৫ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৭ টাকা আত্মসাত করেছেন।

অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ১১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৩৭ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫ লাখ ৪০ হাজার ৬৯৫ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৪৯১ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৬ লাখ ৩৯ হাজার ২৬৮ টাকা, ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৮৬৬ টাকা, ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৪৭ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৮ লাখ ৯০ হাজার ৫৮৬ টাকা ও ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৪ লাখ ৩ হাজার ৩৬০ টাকা আত্মসাত করেছেন। এই সময়ে তিনি কলেজের গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্র, আয়-ব্যয়ের হিসাব, ক্যাশবহি, আয় রেজিষ্ট্রার, ব্যয় রেজিস্ট্রার, পরিচালনা পরিষদের রেজুলেশন বহি, কলেজের জমিজমার দলিল পত্র, অতি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, কলেজের ব্যবহৃত মোবাইল সিম কার্ড আত্মসাত করেছেন।

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ২০২৩ সালের ২৭ নভেম্বর সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় সুজিত কুমারকে। অব্যাহতি দেয়ার পর ১৭ মাস তিনি আর কলেজে আসেন নি। এরপর ২০২৫ সালের ৬ এপ্রিল অবসরে যান। এর আগে তাকে ২০২৪ সালের ২১ জানুয়ারী শোকজ করা হযেছিলো। তিনি কোন জবাব দেননি। তার বিরুদ্ধে বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানায় অভিযোগ দেয়া হয়েছিলো। এছাড়া ফকিরবাড়ি রোডস্থ এক যুবককে চাকরী দেবার কথা বলে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ রয়েছে সুজিতের বিরুদ্ধে।

অপরদিকে সুজিত কুমারের স্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক রীনা রানী সুতার। কলেজটি সরকারিকরণের পূর্বে আওয়ামীলীগ নেতা কাজী মফিজুল ইসলাম কামালের আনুগত্যে চাকরি পান রীনা রানী সুতার। এছাড়া কাজী কামালের স্ত্রী সম্পর্কে রীনা রানীর বান্ধবী। তাই কলেজে অনুপস্থিত থেকেও নিয়েছেন বেতন-ভাতাদি। আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পরে তেমন একটা কলেজে যেতেন না রীনা। এরই মধ্যে স্বামীও অবসরে যান। তাই স্বামী-স্ত্রী দুজনেই উড়াল দিলে লন্ডনে। ফলে ২০২৫ সালের জানুয়ারী মাস থেকে একেবারে অনুপস্থিত শিক্ষক রীনা রানী সুতার।

অভিযোগের বিষয়ে সুজিত কুমার দেবনাথ ও তার স্ত্রীর নম্বরে ফোন করা হলে তা বন্ধ যায়।

এ ব্যাপারে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ আব্দুস সালাম বেপারী বলেন, কলেজে অনুপস্থিত থাকায় ইতিপূর্বে শিক্ষক রীনা রানী সুতারকে দুইটি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। আরও একটি নোটিশ পাঠানো হবে। জবাব না আসলে উধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেয়া হবে।

অডিট ও নিরীক্ষা কমিটি আহবায়ক মুহাম্মদ মুয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, ২০১৫ থেকে অবসরের আগ পর্যন্ত সুজিত কুমার দেবনাথের কাছে ৬৫ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৭ টাকা পাওনা রয়েছে। এছাড়া কলেজের গুরুত্বপূর্ন দলিল ও কাগজপত্র আত্মসাত করেছেন। অডিট রিপোর্ট গভার্নিং বডির কাছে প্রেরণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান বলেন, সুজিত কুমার কলেজটির দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অনিযমের আখড়ায় পরিনত করেছিলো। তাছাড়া চাকরি দেযার কথা বলে অনেকের কাছ তেকে লাক লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন। তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছিলো। তিনি কোন জবাব দেননি। তার বিরুদ্ধে বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানায় অভিযোগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া গত ২৪ এপ্রিল গভার্নিং বডির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।