জাল ওয়ারিশ সনদ, ভূয়া পাওয়ার অব এ্যাটর্নি ও নকল এনআইডি কার্ড ব্যবহার
বানারীপাড়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে জমি আত্মসাত, অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত সংস্থা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বানারীপাড়ায় জাল জালিয়াতির মাধ্যমে জমি আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। জাল ওয়ারিশ সনদ, ভূয়া পাওয়ার অব এ্যাটর্নি ও নকল জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ভূমি অফিসের মাধ্যমে ভূয়া মিউটেশন করেছে আসামীরা। অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে এমন তথ্য উল্লেখ করে গত ২৪ এপ্রিল বরিশাল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে আসামী সুভাষ মন্ডল ও পরিতোষ গাইনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে বানারীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ রুবেল খান।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, ঝালকাঠি সদর উপজেলার কাফুরকাঠি এলাকার মৃত মতিলাল মন্ডলের ছেলে সুভাষ মন্ডল ও বানারীপাড়ার মাছরং এলাকার মৃত ক্ষিতিশ চন্দ্র গাইনের ছেলে পরিতোষ গাইন যোগসাজসের মাধ্যমে পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ থানার জিন্দাকাঠি গ্রামের বাসিন্দা মৃত নিবারন মালীর ছেলে মাধব মালীর কাছ থেকে পাওয়ার অব এ্যাটর্নি নিয়ে জাল ওয়ারিশ সনদ ও ভূয়া কাগজপত্র সৃষ্টি করে বানারীপাড়া উপজেলা সহকারী ভূমি অফিসে মিউটেশন মামলা (মিস কেস নং- ৪৪ বিপি/২০২১-২২) দায়ের করেন। মামলায় সুভাষ মন্ডল উল্লেখ করেন-নিবারন মালির একমাত্র ওয়ারিশ মাধব মালী। আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখর কুমারের এই মর্মে ওয়ারিশ সার্টিফিকেট দাখিল করেন।
এছাড়া রাজস্ব অফিসে মাধব মালীর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য আসামী সুভাষ মণ্ডলকে ক্ষমতা প্রদান করেছে মর্মে একখানা আমমোক্তারনামা দাখিল করেন। এমনকি ওই রাজস্ব অফিস সহ বিভিন্ন স্থানে মাধব মালীর এন.আই.ডি কার্ডের ফটোকপি দাখিল করেন। বিষয়টি জমির প্রকৃত মালিক মনিরুজ্জামান মৃর্ধা জানতে পেরে বরিশাল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে আসামী সুভাষ মন্ডল ও পরিতোষ গাইনের বিরুদ্ধে গত বছর ১২ ডিসেম্বর মামলা (৫২০/২০২৪) দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বানারীপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জকে নির্দেশ দেন।
অনুসন্ধানি প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, বানারীপাড়া থানার অন্তর্গত ৭৪ নং কুন্দিহার মৌজার এস.এ ১৪৪ নং খতিয়ানভুক্ত ৪৫১/৪৫৪ দাগের ৬২ শতাংশ সম্পত্তির মূল মালিক ছিলেন নিবারন মালী। নিবায়ন মালীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী মতিবালা মালী দুই নাবালক পুত্র (মাধব মালী ও বিজয় মালী) দ্বয়ের পক্ষে ১৯৭০ সালে সাব-কবলা দলিল নং ৫০৫৭/৭০ মূলে শ্রী হেমন্ত কুমার দাস এর কাছে ওই জমি বিক্রি করেন। পরে গত ১৯৭২ সালে শ্রী হেমন্ত কুমার দাস কাছ থেকে মামলার বাদীর পিতা মৃত আব্দুল মতিন মৃধা সাব কবলা দলিল মূলে ওই ক্রয় করেন।
পরবর্তিতে ১৯৭৫/৭৬ সালের ৪২৬ ও ৪২৭ নং মিউটেশন কেসের আবেদনমূলে বাদীর পিতা মৃত আব্দুল মতিন মৃধা নামপত্তন করে খাজনা পরিশোধ করে জমি দখলে থাকেন। ২০০৮ সালে আব্দুল মতিন মৃধার মৃত্যুবরণ করায় তার দুই পুত্র, তিন কন্যা ও তার স্ত্রী ওয়ারিশসূত্রে ওই জমির মালিক হয়ে পূর্বের ন্যায় খাজনা ও হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদান করেন। তফসিল বর্নিত জমিতে ৪ টি টিনসেড বিল্ডিং রয়েছে। বিল্ডিং এর ভাড়াটিয়ারা মামলার বাদীকে নিয়মিত ভাড়া প্রদান করে এবং তাদের সম্পত্তি বলে জানে।
মামলার সাক্ষী তারা বিবি জানান, ওই সম্পত্তিতে গত ৪০ বছর যাবৎ মতিন মৃধা থাকেন দিয়েছেন এবং তিনি মতিন মৃধার জমি বলে জানেন। কিন্তু আসামী সুভাষ মন্ডল ও পরিতোষ গাইন পরস্পর যোগসাজশে বাদীর পিতার রেকর্ড কর্তন করে নিবারন মালীর পূত্র মাধব মালীর নামে রেকর্ড সংশোধন করার জন্য ২০২২ সালের ৬ মার্চ বানারীপাড়া ভূমি অফিসে একটি মিউটেশন মামলা দায়ের করেন। যাহার মিস কেস নং ৪৪ (২০২১-২০২২)। ঐ মামলায় মাধব মালীকে নেছারাবাদ থানার জিন্দাকাঠি গ্রামের বাসিন্দা আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়ন পরিষদের একটি ওয়ারিশ সনদ দাখিল করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জিন্দাকাঠী গ্রামে মালী সম্প্রদায়ের কোন লোকজন বসবাস করে না। এমনকি বর্তমানেও কেউ নাই। মাধব মালী, পিতা-নিবারন মালী নামে কোন লোক জিন্দাকাঠী গ্রামে বসবাস করে না এবং ওই ব্যক্তিকে কেউ চিনেনা স্থানীয়রা। এছাড়া আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিঠুন হালদার, জিন্দাকাঠি ওয়ার্ড মেম্বার সবুজ ও স্থানীয় গ্রাম পুলিশ অভিজিৎ হালদার প্রত্যয়ন দেন যে, মাধব মালী, পিতা-নিবারন মালী, সাং-জিন্দাকাঠি, থানা-নেছারাবাদ, জেলা-পিরোজপুর এই নামে কোন ব্যক্তি জিন্দাকাঠী গ্রামে বসবাস করেনা এবং তাহার নামে কোন স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি নাই। তবে ওই নামে বর্নিত ঠিকানায় ভোটার আইডি কার্ড আছে।
পরবর্তীতে বরিশাল বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে মাধব মালীর জাতীয় পরিচয়পত্র নং-১৯৪৩৭৯১৮৭১৭০০০০০১ এর অনুকূলে কোন পার্সপোর্ট ইস্যু করা হয়নি বলে জানা যায়। তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমানে মাধব মালী নামের কোন ব্যক্তির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
অস্বিত্বহীন ব্যক্তি মাধব মালির নাম ব্যবহার করে আসামীদ্বয় যোগসাজসে জাল ওয়ারিশ সনদ ও পাওয়ার অব এ্যাটর্নি সৃষ্টি করে বানারীপাড়া উপজেলা সহকারী ভূমি অফিসে মিউটেশন মামলা করে। আসামীদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে সত্যতা পায় তদন্তকারী কর্মকর্তা।