যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন রাঙ্গাবালীর ২ লাখ মানুষ, বিদ্যুৎ নেই ৩ দিন

পটুয়াখালী প্রতিনিধি : বৈরী আবহাওয়ায় পটুয়াখালীর উপকূলীয় দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালী টানা দুদিন ধরে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। লঞ্চ, স্পিডবোট ও ট্রলার চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় অন্তত দুই লাখ মানুষ এখন ‘দ্বীপে বন্দি’ অবস্থায় পড়েছেন। জীবন-জীবিকার পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজনে যাতায়াত না করতে পারায় তৈরি হয়েছে চরম ভোগান্তি। এদিকে তিনদিন ধরে নেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
রাঙ্গাবালী উপজেলা মূলত সমুদ্র ও নদীবেষ্টিত একটি দ্বীপাঞ্চল। উপজেলার সঙ্গে মূল ভূখণ্ড গলাচিপা কিংবা কলাপাড়া হয়ে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ছিল জলপথ। কিন্তু গত বুধবারের (২৮ মে) পর থেকে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বৈরী আবহাওয়ার কারণে আজ শুক্রবারও (৩০ মে) নৌযান চরাচল চালু হয়নি। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন এখানকার বাসিন্দারা।
বিশেষ করে রাঙ্গাবালীতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স না থাকায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসা নিতে কিংবা বড় ধরনের অসুস্থতায় রোগীদের পটুয়াখালী বা গলাচিপা নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ায় নৌযান বন্ধ থাকায় সেই পথও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে দূরবর্তী এ চরের অনেক পরিবার।
রাঙ্গাবালীর বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. কাশেম মিয়া বলেন, ‘গতকাল আমার ছোট ভাই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে বরিশাল নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু কোনো স্পিডবোট বা ট্রলারই পাওয়া যায়নি। আমরা শুধু অসহায় হয়ে অপেক্ষা করছি।’
স্থানীয়রা জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। কারণ, বাইরের কোনো ট্রলার বা লঞ্চ আসতে না পারায় নতুন পণ্য ঢুকছে না দ্বীপে। তবে পুরোপুরি সংকট এখনও তৈরি হয়নি।
বিদ্যুৎ না থাকায় উপজেলার বাজারগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ফ্রিজে সংরক্ষণযোগ্য পণ্য নষ্ট হয়ে ব্যবসায়ীদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। কম্পিউটার ও ডিজিটাল সেবাদানকারী দোকানগুলোও কার্যত বন্ধ।
বাহেরচর বাজারের কম্পিউটার ও ফটোকপি ব্যবসায়ী প্রিন্স মাহমুদ বলেন, ‘প্রতিদিন বিভিন্ন কাগজপত্র স্ক্যান, ছবি প্রিন্ট আর অনলাইন ফরম পূরণের কাজ করি। বিদ্যুৎ না থাকলে এইসব কিছুই করা যায় না। ল্যাপটপে সীমিত সময় কাজ চললেও প্রিন্টার চালানো সম্ভব নয়। দোকান খোলা থাকলেও লাভ হচ্ছে না। অন্যদিকে সাধারণ মানুষও ভোগান্তিতে পরেছে। জরুরী কাজ করাতে পারছে না।’
এদিকে, বিদ্যুৎ না থাকায় ঘরে ঘরে রেফ্রিজারেটরে রাখা মাছ, মাংস, দুধসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতির মুখে পড়ছে সাধারণ পরিবারগুলো। পূর্ব বাহেরচর গ্রামের গৃহিণী রোজিনা বেগম বলেন, ‘সাপ্তাহিক বাজার একবারেই করি। ফ্রিজে মাছ-মাংস, দুধ রেখে দিই। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় সব কিছু পচে গেছে। এখন সব ফেলতে হচ্ছে। ছোট বাচ্চার জন্য দুধ কিনেও রাখতে পারছি না। একে তো দ্রব্যমূল্যের চাপ, তার ওপর এই ক্ষতি, এনিয়ে চরম দুর্ভোগে আছি।’
বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল চার্জ দিতে না পারায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে, কর্মজীবীরা যেতে পারছেন না সময়মতো কর্মস্থলে।
রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইকবাল হাসান বলেন, ‘মানুষের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই নৌযান চলাচলে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে ফের চলাচল চালু হবে। জরুরি প্রয়োজনে নৌপুলিশ বা কোস্টগার্ডের সহায়তায় ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।’
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ এখনও সক্রিয় রয়েছে। ঝোড়ো হাওয়া ও দমকা বাতাস অব্যাহত থাকায় পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা কম। নদীপথে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত জারি আছে।
রাঙ্গাবালীর এই বিচ্ছিন্নতা শুধু একটি দুর্যোগকালীন সমস্যাই নয়, বরং এটি দ্বীপাঞ্চলের দীর্ঘদিনের অবকাঠামোগত দুর্বলতার প্রতিফলন। কোনো স্থলপথ না থাকায় শুধু বৈরী আবহাওয়াই নয়, একটি অসুস্থতা বা প্রয়োজনীয়তার মুহূর্তও এখানে হয়ে উঠতে পারে জীবনের জন্য হুমকি।