নদী ভাঙ্গনে ছোট হচ্ছে ভোলার মানচিত্র

জুন ২৮ ২০২৫, ১৯:২০

ভোলা প্রতিনিধি : ভোলায় নদী ভাঙ্গনের ফলে ৩ হাজার ৪৪৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভোলা থেকে গত ৫০ বছরে ২৫৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মেঘনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অতচ ভোলাকে রক্ষার জন্য বছরের পর বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করার চেস্টা করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে বলে মনে করেন ভুক্তভোগী অসহায় মানুষ। অবৈধ বালু উত্তোলন এর জন্য দায়ী বলে মনে করছে ভোলার সুধীজনরা। তারা মনে করে চীনের দঃখ হোয়াং হু নদী আর ভোলবাসীর দুঃখ নদী ভাঙ্গন।

আর এর জন্য দায়ী অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। তাদের ধারনা ভোলাকে রক্ষার নামে বরাধ্বে এক শ্রেনীর লোকজনের পকেট ভারী হচ্ছে। প্রতি বছরই বর্ষার সময় উজানের পানির চাপে ভোলার মেঘনায় নদী তীব্র ভাঙন দেখা দেয় । যার কারনে এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ঘরবাড়ি,ফসলি জমি’সহ বিভিন্ন স্থাপনা। হুমকির মুখে পড়েছে মাছ ঘাট, শত শত ঘরবাড়ি,বাজার ও মসজিদসহ বহু মাছের ঘের। ভিটেমাটি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে নদী পাড়ের মানুষ।

দেশের বৃহত্তম এই দ্বীপজেলাকে রক্ষার জন্য বছরের পর বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও ঠেকানো যাচ্ছে এ ভাঙন। নদী শাসনের মাধ্যমে স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ না করে পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধু জিও ব্যাগ ডাম্পিং এবং সি.সি.ব্লক দ্বারা নদী তীর আচ্ছাদিত করার মতো অস্থায়ী প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু সেই সি.সি.ব্লক আর জিও ব্যাগেও সুফল মিলছে না। স্থানীয়দের মতে,এ ধরনের অপরিকল্পিত প্রকল্প নিয়ে শুধু রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছ,কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মাঝে কিছু লোকের পকেট ভারী হচ্ছে। আর এ ভাঙনের ধারাবাহিকতায় দ্বীপজেলা ভোলার মানচিত্র থেকে গত ৫০ বছরে ২৫৭ বর্গকিলোমিটার জনপদ হারিয়ে গেছে ।ফলে ভাঙাগড়ার খেলায় ছোট হয়ে আসছে ভোলা,বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কি পরিমাণ মানুষ যে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছে তার সঠিক কোন তালিকা নেই স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পাউবোর কাছে। পাউবো সূত্র জানায় , ৩ হাজার ৪৪৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভোলা থেকে গত ৫০ বছরে ২৫৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মেঘনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতি বছরই ভেঙে যাচ্ছে ১ থেকে ২ বর্গকিলোমিটার এলাকা। যদিও ভাঙন বন্ধে গৃহীত হচ্ছে ছোট-বড় স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প কিন্তু তাতে আশানুরূপ ফল মিলছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাঙন বন্ধে স্থায়ী পদ্ধতি হচ্ছে-নদী শাসন করে প্রকল্প গ্রহণ করা। এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা ও যমুনা’সহ বিভিন্ন সেতু এলাকার ভাঙন বন্ধের নজির রয়েছে। কিন্তু ভোলায় নদী শাসনের মতো তেমন প্রকল্প নেই। আছে শুধু জিও ব্যাগ ডাম্পিং এবং সি.সি.ব্লক দ্বারা নদী তীর আচ্ছাদিত করার মতো অস্থায়ী প্রকল্পই বার বার নেয়া হচ্ছে।

আবার এ ভাঙনের মধ্য দিয়ে মেঘনার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ড্রেজার দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভোলার ইলিশা, রাজাপুর, কাচিয়া, মাঝেরচর মদনপুর এবং শিবপুর ইউনিয়নে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে এসব এলাকাগুলোতে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট,মসজিদ, মাদরাসা ও ফসলি জমি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে কয়েক লক্ষাধিক মানুষ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ভোলা সংলগ্ন মেঘনায় অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন এবং সাম্প্রতিককালের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল স্রোতে শস্যভাণ্ডার খ্যাত ভোলার মেঘনা নদী বেষ্টিত সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন মাঝের চর এলাকায় প্রবল ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত ১৫ দিনের ভাঙনে সেখানে গৃহহীন হয়ে পড়েছে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার। ভেঙে গেছে একটি বাজার, মসজিদ, ২টি মক্তব, হেফজ মাদ্রাসাসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

ভাঙনের তীব্রতা এতোই বৃদ্ধি পেয়েছে যে অনেক পরিবার তাদের ঘরবাড়ি সরিয়ে অন্যত্র নেওয়ার সময়ও পাচ্ছেন না। যারা ভাঙন থেকে বসতঘর রক্ষা করতে পারেননি, তারা নিঃস্ব হয়ে নদী পাড়ে বসে আর্তনাদ করছেন। চোখের পলকেই মেঘনা নদীতে বাড়ি ঘর ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে স্থানীয়রা। ফলে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে এই চরে বসবাসকারী দুই গ্রামের প্রায় ৮ হাজার মানুষের। তবে নদী ভাঙনরোধে ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় স্থানীয়দের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। পাউবোর ডিভিশন – ১ নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়া উদ্দিন আরিফ জানান চরের কোন বরাধ্ব না থাকায় সেখানে কোন তাজ করা যাচ্ছে না।

কাচিয়া চরের বাসিন্দা আবুল হোসেন মাঝি বলেন, নদী আগে অনেক দূরে ছিল। এখন খুব জোরেশোরে ভাঙছে। নদী আমাগো বাড়িঘর ভাইঙা নিয়া গেছে। এখন আমরা কই যামু? কি থাকমু, কেমনে বাচমু কিছুই জানিনা। অপর বাসিন্দা আরজন আলী বলেন, ভাঙতে ভাঙতে নদী আমাগো ঘরের লগে আইস্যা গেছে। যহন-তহন আমাগো ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা লইয়া যাইতে পারে। ভেঙ্গে যাচ্ছে তজুমুদ্দিনের, চরফ্যাশন, মনপুরা অনেক স্থান।

স্থানীয়রা বলেন,নদী এই পর্যন্ত আমাদের ৭/৮বার ভাঙছে। ভাঙনের শিকার এসব মানুষ সরকারের কাছে শুধু মাথা গোজার ঠাঁই চান। সম্প্রতি ভোলায় ঘূর্ণিঝড় “শক্তি ও মন্থায়” ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের ব্রিচ দ্রুত মেরামত কাজ পরিদর্শন করেন দক্ষিণাঞ্চল, বরিশালের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার নির্মাণাধীন ধরনী স্লুইস প্রকল্পের রিং বাঁধে প্রায় ১৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ব্রিচ (ধস) সৃষ্টি হয়। এতে এলাকার অনেক ক্ষতি হয়েছে।

এ ছাড়াও ভাঙন কবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এনামুল হক। তিনি জেলা সদর ভোলার ভাঙ্গনকবলিত শিবপুর ইউনিয়নের মাছঘাট ও স্লুইজগেট এলাকাও পরিদর্শন করেন।

স্থানীয়রা জানান, নদীর ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। বেড়ীবাঁধ ভেঙে গেলে অতি জোঁয়ার ও স্রোতে আমরা ভেসে যাবো। বর্তমানে এ বাঁধ থেকে নদী মাত্র ১০০ ফুট দূরে রয়েছে।বেশি ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বাঁধের বাইরে মেঘনার কুল ঘেঁষে বসবাসরত পরিবারগুলো ভাঙনের শিকার হয়ে অন্যত্রে চলে গেছে। কেউবা ঠাঁই নিয়েছেন বেড়িবাঁধের পাশে। কিন্তু অচিরেই এই বেড়িবাঁধও ভেঙে যাওয়ার পথে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ মিজানুর রহমান জানান,জেলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের স্লুইসগেট পয়েন্টে যে মাছ ঘাট রয়েছে, সেখান থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এখন ভাঙন চলমান রয়েছে। নদী ভাঙন রক্ষায় যে প্রকল্প পাঠিয়েছি তা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-০১ এর ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান জানান শিবপুর ইউনিয়নটি মেঘনা নদীর তীরবর্তী। বেড়ীবাঁধ থেকে নদীর দূরত্ব ৬০ থেকে ৭০ মিটার। বর্তমানে এ এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদী ভাঙন রোধে ৪ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ এবং ৬ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২৬০ মিটার দৈর্ঘ্য নদী ভাঙনরোধে কাজ শুরু করে দিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা সাময়িক ভাবে ভাঙন রোধ করতে পারবো।নি জানান, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে ভাঙন রোধের গুরুত্ব অনুভব করেছেন। এ জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে,এটি অনুমোদন হলে নদী ভাঙন সম্পূর্ণ রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন জেলা প্রশাসনের এ কর্মকর্তা।

পাউবোর ডিভিশন -২ নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আসাফউদ্দৌলা জানান বর্ষা ও উজানের পানির চাপে তজুমুদ্দিন, চরফ্যাশন ও কিছু অংশে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। পাউবো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে মনিটরিং রয়েছেন যখনই কোন সমস্যা দেখা দেয় সাথে সাথেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে সমাধান করা হয়।