ঝালকাঠিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কোটি টাকার প্রকল্পে অনিয়ম

আগস্ট ২৬ ২০২৫, ১৯:৩৬

ঝালকাঠি প্রতিনিধি : ঝালকাঠি জেলার দক্ষিণাংশে বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমসহ প্রায় সারা বছরই খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নমুখী হওয়ায় শহর ও গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ নলকূপ থেকে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে গ্রামের মানুষ দৈনন্দিন কাজ ও নিরাপদ পানি সংগ্রহের জন্য অন্যত্র যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকার হাতে নিয়েছিল বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্প, যা বর্ষার পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারযোগ্য করে তুলবে। তবে তা বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পানির সংকটে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিশাল প্রভাব পড়ছে। এই প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন না হলে বর্ষার পানি সংরক্ষণ ও শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারের লক্ষ্য পূরণ হবে না। আর এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।

ঝালকাঠি জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের আওতায় সদর উপজেলা বাদে জেলার তিন উপজেলায় ২০২২-২৩,২৩-২৪ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৫ হাজার ৪২৫টি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। মূল লক্ষ্য ছিল গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে ট্যাংক বসিয়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, প্রকল্পের বড় অঙ্কের বিল ইতোমধ্যেই উত্তোলন করা হয়েছে। ঠিকাদাররা ২০ কোটি টাকার বিল উত্তোলন করেছেন, কিন্তু প্রকল্পের সুবিধা গ্রামীণ মানুষদের কাছে পৌঁছায়নি। বিশেষ করে কাঁঠালিয়া উপজেলার দূর্গম এলাকায় অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রকল্প যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়নি।

কাঁঠালিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অনেক স্থানে ট্যাংক বসানো হলেও তার উপরে ছাউনি নেই। কিছু ট্যাংকি মাসের পর মাস ফেলে রাখা হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যে মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে তা ঠিকাদারের দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় বাসিন্দাদের বহন করতে হয়েছে। বহু ইউনিয়নে ট্যাংক, পাইপ, সিমেন্ট, বালি ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী নিজ খরচে আনতে হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। অনেক স্থানে ট্যাংক ফেলা রেখে হয়েছে এবং শেড বা প্লাটফর্ম নির্মাণের দায়িত্বও ঠিকাদার যথাযথভাবে পালন করেননি। তা ছাড়া শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের বিষয়েও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে স্থানীয় সুবিধাভোগীরা নিজের খরচে শ্রমিক নিয়োগ ও কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছে। এই সমস্ত অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রকল্পের কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং প্রকল্পের লক্ষ্য, বর্ষার পানি সংরক্ষণ ও শুষ্ক মৌসুমে নিরাপদ পানি সরবরাহ সঠিকভাবে অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

জেলার চারটি উপজেলার মধ্যে উপকূলীয় কাঠালিয়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পানির সংকট রয়েছে। তাই এই উপজেলাটির একাধিক ইউনিয়নে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের বাস্তবায়নে অনিয়ম সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

কাঠালিয়ার পাটিখালঘাটা ইউনিয়নের মো. শাহআলম তালুকদার বলেন, প্রায় এক বছর আগে আমার বাড়িতে ট্যাংকি বসানো হয়। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি পাইনি, মিস্ত্রি নিজেই আমি নিয়েছি। মালামাল আনাও আমার খরচে। ঠিকাদারের কেউ কাজ দেখেনি। অনেক স্থানে শুধু ট্যাংকি এনে ফেলে রাখা হয়েছে। পাইপসহ মালামাল ২–৩ মাস ধরে সরবরাহ হয়নি।

কৃষক অদুদ মিয়া বলেন, আমার বাড়িতে ইট, বালি, সিমেন্ট ও ট্যাংক নিজ খরচে আনতে হয়েছে। প্রায় ১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, তারপরও ট্যাংকের পাইপ ঠিকমতো সংযুক্ত হয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজের খরচে পাইপ লাগাতে হয়েছে।

জসিম নামের আরেক কৃষক বলেন, আরও দুই তিন মাস আগে ট্যাংক আনেছি। এখনও এটি পরে আছে। চালু করার জন্য কোনো মালামাল সরবরাহ হয়নি। তাই বর্ষার পানি ধরে রাখতে পারছি না, খালের পানি বিশুদ্ধ করে খেতে হচ্ছে।

তিন উপজেলায় তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে। এর মধ্যে কাঠালিয়া উপজেলার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসপি লি. এর মো. জাফরুল হক বলেছেন, আমাদের কাঁঠালিয়াতে ১৮০৯টি কাজের মধ্যে মাত্র ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এখনো অসমাপ্ত কাজের মধ্যে ট্যাংকের প্লাটফর্ম, টিনের শেডসহ যাবতীয় মালামাল নেওয়া এবং কানেকশন দেওয়া বাকি আছে। বর্ষার কারণে এক মাস কাজ করতে পারিনি। তিন বছর ধরে একই কাজ করতে গিয়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা লস হবে। কাঠালিয়ার দূর্গম এলাকায় মালামাল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এখনো প্রায় ১০০ ট্যাংকের কাজ বাকি। মালামাল পরিবহনের খরচ আমাদের বহন করতে হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্বে) সাইফুর রহমান বলেন, প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান আছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে টেন্ডার হয়ে ছিল। একটি প্যাকেজে ট্যাংকের উপর পাকা পিলার দিয়ে টিনের শেড করা হয়েছে। মালামাল আনার খরচ ঠিকাদারের। শেড নির্মাণ ও মালামাল বহনের খরচ টেন্ডারে কত ধরা আছে, তা আমি বলতে পারি না। কাঠালিয়ায় দায়িত্বে থাকাকালীন শেড নির্মাণ না হওয়া বা মালামাল বহনের খরচ ঠিকাদার বহন করেনি এমন অভিযোগ পাইনি।

নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার এরশাদুজ্জামান মৃদুল বলেন, ঝালকাঠি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের লোকবল কম, তাই প্রতিটি প্রকল্পে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে মালামাল বহন ও শেড নির্মাণের দায়িত্ব ঠিকাদারের। প্রথমে বাঁশ দিয়ে শেড করানো হয়েছে, পরে পাকা পিলারের নির্দেশ দিয়েছি। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেব। একটি প্যাকেজের কাজ বন্ধ থাকায় ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, অবিলম্বে কাজ শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।