সেবার নামে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারে বাণিজ্য

৫ বছরে বরিশালে অপচিকিৎসায় ১৩ জনের মৃত্যু

আগস্ট ৩১ ২০২৫, ২১:৫৮

ফাহিম ফিরোজ, বরিশাল : বরিশালে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার। পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী, জনবল, টেকনিশিয়ান ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানী। গত ৫ বছরে এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অপচিকিৎসায় ১৩ জনের অধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল জেলার উপজেলাগুলোতে অনুমোদিত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৬০টি। এছাড়া বরিশাল মহানগর এলাকায় ১৪৯টি অনুমোদিত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক রয়েছে। এ সব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অপচিকিৎসায় ঝড়ে যাচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ।

জানা গেছে, চলতি বছরের ১০ মে বরিশাল নগরীর ফেয়ার হেলথ ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় হাফসা আক্তার রুপা (২৫) নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। মৃত রুপা নগরীর নতুন বাজার গুপ্ত কর্নার এলাকার নাসিমা বেগমের মেয়ে।

আগৈলঝাড়া উপজেলায় ভুল চিকিৎসায় চলতি বছরের গত ২৫ আগস্ট সাবেক ইউপি সদস্য লিপিকা বালা (৬০) নামের এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। মৃত লিপিকা বালা রাজিহার ইউনিয়নের কান্দিরপাড় গ্রামের প্রয়াত সুনীল বালার স্ত্রী। এ ঘটনায় গ্রাম্য চিকিৎসক কিরন বেপারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

২০২৪ সালের রোববার (২১ এপ্রিল) নগরীর বগুড়া রোড সাউথ বেঙ্গল ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় লামিয়া রিয়া (১৯) নামের এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। লামিয়া নেছারাবাদ উপজেলার জলাবাড়ি ইউনিয়নের কামারকাঠি গ্রামের সাব্বির হোসেনের স্ত্রী। ওই ক্লিনিকে লামিয়ার সিজার অপারেশন হয়।

২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল নগরীর সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা সংলগ্ন সেন্ট্রাল হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল চিকিৎসায় রুবি আক্তার নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। মৃত রুবি আক্তার নগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের দিয়াপাড়া এলাকার রফিক সিকদারের স্ত্রী। তবে তার বাচ্চা সুস্থ রয়েছে।

২০২৩ সালের ২ আগস্ট বরিশাল নগরীর বেসরকারি রাহাত আনোয়ার হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় নিতম্ব থেকে সুঁই বের করতে গিয়ে ছয় মাসের তানজিম ইসলাম নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। মৃত তানজিম পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ডাউকা গ্রামের ফিরোজ খানের ছেলে।

২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল ডাক্তারের ভুল অপারেশন ও অবহেলায় নগরীর কালিবাড়ি রোডস্থ বরিশাল মেট্রোপলিটন হাসপাতালে সুমাইয়া নামে এক প্রসূতির মুত্যু হয়। এ সময় তার গর্ভের সন্তানও মারা যায়। মৃত সুমাইয়া চরমোনাই এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।

২০২৪ সালের ৩ জুলাই বরিশালের গৌরনদীতে হেলথ কেয়ার ক্লিনিকে চিকিৎসকের অবহেলায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যু হয়। মৃত প্রসূতির নাম নাজমুন নাহার। তিনি পার্শ্ববর্তী বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের উত্তর চরভুতেরদিয়া গ্রামের আমিনুল ইসলামের স্ত্রী।

২০২০ সালের ২৭ এপ্রিল বরিশাল নগরীর ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকার রয়েল সিটি হসপিটালে ভুল চিকিৎসায় সোনিয়া বেগম ২৪ নামের এক গৃহবধূ মৃত্যু হয়। মৃত সোনিয়া ঝালকাঠির বিনাইকাঠি বাজিতপুর গ্রামের প্রবাসী সাইফুল ইসলাম এর স্ত্রী।

২০২০ সালের ১৩ আগস্ট বরিশাল নগরীর বেলভিউ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসকের অবহেলায় প্রসূতি নারী শাহনাজ পারভীনের (৪০) মৃত্যু হয়। মৃত শাহানাজ পারভীন জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার তরিকুল ইসলামের স্ত্রী। তার পৈতৃক বাড়ি ঝালকাঠীর রাজাপুরে। তার গর্ভের সন্তানও মারা যায়।

২০২৪ সালের ১৩ মার্চ বরিশালের গৌরনদীতে শিকদার ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসা ও দায়িত্ব অবহেলায় দ্বীপায়ন রায় (৯) নামে এক স্কুল ছাত্রের মৃত্যু হয়। দ্বীপায়ন পাশ্ববর্তী উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের কারফা গ্রামের দুলাল রায়ের ছেলে ও কারফা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিলো।

ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর বিষয়ে স্বজনদের মামলা মোকদ্দমা করতে ভয়-ভীতি দেখানো। এক্ষেত্রে মৃত্যুর অভিযোগগুলো রফাদফায় ঢাকা পড়ে যায়।

তবে এ ধরণের মৃত্যুতে কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল না বলে দাবি করে বরিশাল ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কেএম সহিদউল্লাহ বলেন, আমাদের অধিন ৮০টি ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক রয়েছে। এগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী চলছে।

এদিকে ২০২৩ সালের ২ অক্টোবর বানারীপাড়ার হামিদ মেমোরিয়াল হাসপাতাল নামে একটি বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে অস্ত্রোপচারের পর প্রসূতির পেটে গজ কাপড় রেখে সেলাই চিকিৎসক। ১৭ দিন পরে দ্বিতীয় দফায় অস্ত্রোপচার করে ওই প্রসূতির পেট থেকে তা বের করা হয়। এছাড়া ২০২৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বরিশালের ‘বেলভিউ হসপিটাল এন্ড মেডিকেল সার্ভিসেস’র ভুল চিকিৎসার কারণে ৯ মাস বয়সী শিশু সন্তান রায়হান অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। নগরীর মহাবাজ এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ হৃদয়ের নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়া ওই শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিক ‘ভ্যানমাইসিন’ প্রয়োগ করার পরপরই আরও অসুস্থ হয়ে যায়। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাতে গিয়ে উল্টো খারাপ আচরণ ও হেনস্তার শিকার হন তিনি।

বরিশাল সিভিল সার্জন ডা: এস.এম মনজুর এ এলাহী বলেন, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ দিলে আমরা তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তাছাড়া আমাদের মনিটরিং ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।