ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন উৎপাদন

আসছে বৈশাখ, কমছে ইলিশের উৎপাদন, বাড়ছে দাম

এপ্রিল ১০ ২০২৫, ১৭:০৪

ফাহিম ফিরোজ ॥ আর মাত্র কদিন পরেই পহেলা বৈশাখ। চলছে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ। অন্যদিকে কমছে ইলিশের উৎপাদন। বৃদ্ধি পাচ্ছে দাম। ফলে এবারের পহেলা বৈশাখে ইলিশ পান্তা উৎসব নিয়ে দেখা দিয়েছে দুঃশ্চিন্তা।

মৎস্য বিভাগ থেকে জানা গেছে, গত ছয় বছরের মধ্যে ইলিশের উৎপাদন প্রথমবারের মতো কমেছে। ২০২৩-২০২৪ সালে মৎস্য উৎপাদন বিগত বছরের চেয়ে কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে অতি আহরণ, ইলিশ চলাচলের পথে নাব্যতার অভাব, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া সহ জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন ইলিশ বিজ্ঞানীরা।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, সর্বশেষ গত ২০২৩-২০২৪ সালে ৫.২৯ লক্ষ মেট্রিক টন ইলিশ সারাদেশে আহরিত হয়েছে, যা বিগত ২০২২-২৩ সালের চেয়ে ৪২ হাজার মেট্রিক টন কম। তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২০২৩ সালে ইলিশের উৎপাদন ৫.৭১ লক্ষ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ সালে ৫.৬৬ লক্ষ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ সালে ৫.৬৫ লক্ষ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ সালে ৫.৫০ লক্ষ মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ সালে ৫.৩২ লক্ষ মেট্রিক টন ও ২০১৭-২০১৮ ৫.১৭ লক্ষ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে।

গত বছর ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়া প্রসঙ্গে, বিএফ আর আই রিভারাইন স্টেশন, চাঁদপুরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু কাওসার দিদার, জানান “গত বছর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে, জেলেরা নদী ও সাগরে স্বাভাবিকভাবে মাছ ধরতে যেতে পারে নাই এর ফলে মাছের আহরণ কমেছে “
তবে “বিভিন্ন কারণে মাছের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে -বিশেষ করে ইলিশ মাছের প্রধান মাইগ্রেশন যে তিনটি পয়েন্ট থেকে হয়, বিশেষ করে মেঘনা -তেতুলিয়া, পায়রা -বিষখালী ও সুন্দরবন অঞ্চলে, নাব্যতার সংকট দেখা দিয়েছে। ইলিশ মাছের জন্য ৫ মিটারের বেশি গভীরতা আদর্শ হলেও, এই নৌপথ গুলিতে কোথাও কোথাও দুই থেকে তিন মিটার পর্যন্ত পানি রয়েছে। পর্যাপ্ত গভীরতা না থাকায়, ইলিশ চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায়, নদীতে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ আসছে না। এছাড়াও, ইলিশের মাইগ্রেশন পথে, প্রচুর পরিমাণ ইলিশ আহরন করতে থাকাও, ইলিশের উৎপাদন কমে আসার কারণ বলে আমরা লক্ষ্য করছি। সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তন, সহ ইলিশের সহনীয় পরিবেশ না থাকার কারণে ও ইলিশের উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অফিসের উপ পরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, ইলিশের উৎপাদন, গত বছরের সামান্য কিছুটা কম হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করছি ইলিশের প্রধান পথগুলিতে আগের মত ইলিশ আসছে না, এর ফলে এটি উৎপাদনের প্রভাব ফেলছে। এই কর্মকর্তা জানান এখন ইলিশের উৎপাদন একেবারেই কম, তবে জুন জুলাই মাসে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। তিনি জানান জাটকা সংরক্ষণে, প্রচেষ্টা চালালেও, লক্ষ লক্ষ জেলে, বিভিন্নভাবে অবৈধভাবে, জাটকা শিকার করছে -তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান করা হলেও, শত শত কিলোমিটার, নদী ও মোহনা পাহারা দেয়া দুঃসাধ্য।

জেলে আলাউদ্দিন মিয়া জানান, গত বছর, আমরা যতটুকু ইলিশ ধরেছি, তা দিয়ে, ধার দেনা, শোধ করে চলতে পারছি না। ইলিশের মৌসুমেও, কোন সময়, দুই মনের উপরে ইলিশ গত কয়েক বছরের মধ্যে পাওয়া যায়নি। নদীতে ইলিশ কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে সমুদ্রের গভীরে ইলিশ শিকার করতে হচ্ছে। এর ফলে আগের চেয়ে বেশি দুর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছে জেলেরা। কুয়াকাটা অঞ্চলের জেলে ইব্রাহিম হাজী জানান, কোন কোন সময় জেলেরা খালি হাতে, আসছে। এর ফলে, দের থেকে দুই লক্ষ টাকা খরচ করে, তারা ঋণে জড়িয়ে পড়ছে। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য, তারা, নিষিদ্ধ জাল, উৎপাদন নিষিদ্ধ করা, অভিযান জোরদার করা আহ্বান জানান।

বাংলা নববর্ষ কে সামনে রেখে বরিশালে ইলিশের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। পাইকারদের বড় সাইজের ইলিশ মাছের মজুদ ও বাজারে ইলিশ সরবরাহ আশঙ্কা জনকভাবে কমে যাওয়ায় কারণেই, ইলিশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে, ইলিশ ব্যবসায়ীরা। এর ফলে ইলিশের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ঘটেছে। দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের অন্যতম মোকাম পোর্ট রোড বাজারে ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

পোর্ট রোড বাজারের ব্যবসায়ী জহির সিকদার বলেন, পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ইলিশের দাম, বেড়েছে আরও বাড়বে। তিনি বলেন ইলিশ মাছের সংকট যা পাওয়া যায়, তা স্থানীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। নববর্ষ কে কেন্দ্র করে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও বড় বড় শহরের হোটেলগুলো, তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে ইলিশ মাছ সংগ্রহ করছে। এর ফলে ইলিশের চাহিদা তুঙ্গে। কিন্তু নদীতে মাছের সরবরাহ একেবারেই কম -এর ফলেই দামের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে আধা কেজি ওজন সাইজের মাছে দাম প্রতি কেজি এক থেকে দেড় হাজার টাকা চায়। অন্যদিকে ১ কেজি সাইজের উপরে মাছের, কেজি ৩ হাজার টাকার উপরে। পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, ২০০ ৩০০ গ্রামের মাছের দামও, অন্তত ঈদের আগের তুলনায় ৫০ ভাগ বেড়েছে। তবে কেজি সাইজের মাছ, ইতোমধ্যেই দুই থেকে আড়াই গুণ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে।

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ জানান, এখন, হিজলা মেহেন্দিগঞ্জ ও ভোলা অঞ্চলের, মৎস্য অভয়ারণ্য মাছধারার উপরে নিষেধাজ্ঞা চলছে। আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা চলবে। এর ফলেই বাজারে মাছের সরবরাহ অনেক কম। এছাড়া জাটকা সংরক্ষণে অভিযান পরিচালিত হওয়ায়, বাজারে মাছ চাষের সুযোগ অনেক কম, এর ফলে দাম বাড়ছে।