এক বছরে ৬৫৮১ সিজার, নরমাল ডেলিভারি ২৮৮৩
শেবাচিমে প্রতিদিন ১৯ গর্ভবতীর সিজার

ফাহিম ফিরোজ, বরিশাল ॥ দিন দিন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্ত্রপচারে (সিজার) সন্তান জন্মদান পদ্ধতি। ফলে গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যুঝুকির পাশাপাশি শিশুদের দেখা দেয় নানা ধরণের সমস্যা। আর অর্থের অপচয় হচ্ছে প্রকট আকারে। দখিণের কোটি মানুষের চিকিৎসা সেবার অন্যতম স্থান বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হাসপাতালটিতে প্রতিদিন ৩৯৯২ জন সেবা প্রার্থী চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে প্রতিদিন ২০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে এসে মৃত্যুবরণ করেন। এই সময়ে ৬ হাজার ৫৮১ জন গর্ভবতীকে সিজার (অস্ত্রপাচরে সন্তান জন্মদান) করা হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১৯ জনের সিজার করা হয় শেবাচিমে। এছাড়া এই সময়ে ২ হাজার ৮৮৩জন গর্ভবতী নরমাল ডেলিভারীর মাধ্যমে সন্তান জন্মদিয়েছে।
জানা গেছে, বিভাগের ছয়টি জেলা হাসপাতালের চারটিকে ১০০ থেকে আড়াই শ শয্যায় উন্নীত করে বড় বড় অবকাঠামো ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া জেলা ও উপজেলা শহরে রয়েছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর। কিন্তু চিকিৎসক টেকনোলজিস্ট, কর্মচারী-সংকটে সেখানে কার্যত চিকিৎসাসেবা বলতে তেমন কিছু নেই। সেখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে যাঁদের অবস্থা গুরুতর, তাঁদের রেফার করা হয় বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মূমুর্ষ সেই গর্ভবর্তীদের বড় একটা অংশ মারা যায়। পাশাপাশি বিভাগের ৪২টি উপজেলার মধ্যে ৪০টিতে যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে, সেসব চিকিৎসাকেন্দ্রে মূলত চিকিৎসাসেবা কার্যত নামে আছে, বাস্তবে নেই। সেখান থেকেও মুমুর্ষ রোগীতে পাঠানো হয় শেবাচিমে। জেলা এবং উপজেলা পর্যায় থেকে সাধারনত জটিল ও খারাপ রোগী শেবাচিমে আসেন। তাই এখানে জন্ম ও মৃত্যুর হারও বেশি।
শেবাচিম হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০২৪ সালে ১৪ লাখ ৫৭ হাজার ৩৬২ জন সেবা প্রার্থী চিকিৎসা নিয়েছেন। এই সময়ে ৭ হাজার ১৩৭ জন চিকিৎসা নিতে এসে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই হিসেবে প্রতিদিন মারা যায় ২০ জন রোগী। অপরদিকে প্রতিদিন ১ হাজার ৯০২ জন রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রতিদিন নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে আড়াই হাজারের উপরে রোগী ভর্তি থাকে হাসপাতালটিতে। হাসপাতালটিতে চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতিরও সংকট বিদ্যমান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ১৩ হাজার ২৮২ জন রোগীকে মেজর সার্জারি চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ২০ হাজার ১৫৯জনকে মাইনর সার্জারি চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
শেবাচিম হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে ৫৫৫, ফেব্রুয়ারিতে ৫১২, মার্চে ৫১৭, এপ্রিলে ৪৫২, মে মাসে ৪৬৫, জুনে ৪৫৬, জুলাইতে ৫০৮, আগস্টে ৫৯৬, সেপ্টেম্বরে ৬৯৮, অক্টোবরে ৬২৮, নভেম্বরে ৫৪২ ও ডিসেম্বরে ৬৫২ জন গর্ভবতীর সিজার হয়। অপরদিকে শেবাচিম হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে ২২৭, ফেব্রুয়ারিতে ২১২, মার্চে ২২৯, এপ্রিলে ২১৭, মে মাসে ২১৪, জুনে ২১০, জুলাইতে ২১৬, আগস্টে ২৫৭, সেপ্টেম্বরে ২৭৪, অক্টোবরে ৩১০, নভেম্বরে ২৫৯ ও ডিসেম্বরে ২১৩ জন গর্ভবতীর নরমাল ডেলিভারী হয়।
চিকিৎসকদের মতে সিজারিয়ান কেন প্রয়োজন:
সিজারিয়ান শিশুদের মধ্যে অ্যালার্জি ও হাঁপানির প্রবণতা বেশি থাকে। এ ছাড়া ডায়রিয়া হওয়ার ঝুঁকি ৪৬ গুণ বেশি থাকে। যখন মায়ের প্রসব-পথ সরু বা চাপা থাকে, প্রসবের পথে যদি কোনো টিউমার থাকে, গর্ভফুল নিচের দিকে থাকলে, শিশুর অবস্থান আড়াআড়ি বা উল্টা থাকলে, শিশুর ওজন অতিরিক্ত বেশি হলে অথবা মাথার আয়তন প্রসব-পথের চেয়ে বড় হলে, প্রসবের আগে মায়ের রক্তক্ষরণ শুরু হলে, মায়ের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকলে, ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো জটিল রোগ থাকলে, আগের দুটি সন্তান সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি হলে, প্রসববেদনা ওঠার ৬ থেকে ১৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ডেলিভারি না হলে, ৩৫ বছর বয়সের পর অথবা ১৯ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে প্রথমবারের মতো গর্ভধারণ করলেও সিজার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
চিকিৎসকদের মতে সিজারিয়ানে মায়েদের যে সকল সমস্যা হয়:
স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান করা মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি তিন গুণ বেশি। সিজারিয়ান শিশু মায়ের দুধপানে বেশি সমস্যার মুখে পড়ে। সিজারিয়ান অপারেশনে মাকে অস্ত্রোপচারের জন্য যেসব চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, তা নবজাতকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বুকের দুধপানে বাধা তৈরি করে। সি-সেকশনে জন্ম নেওয়া শিশুদের প্রাইমারি পালমোনারি উচ্চ রক্তচাপ পাঁচ গুণ বেশি। সিজারিয়ান শিশুর রক্তে সংক্রমণের হার বেশি, এমনকি থাকে জন্ডিস দেখা দেওয়ার আশঙ্কা। সি-সেকশনে জন্ম নেওয়া শিশু পরবর্তী সময়ে সিজোফ্রেনিয়ার মতো গুরুতর মানসিক রোগে ভোগার ঝুঁকিতে থাকে।