২ বছরে ৬৯৩ ধর্ষণ মামলা
বরিশালে দুই বছরে একটি ধর্ষণ মামলাও প্রমাণিত হয়নি

স্টাফ রিপোর্টার : শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের তথ্য বলছে, গত দুই বছরে বরিশালে কোনো ধর্ষণ হয়নি। অথচ এ সময়ে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৯৩টি। এ সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ ধর্ষণচেষ্টার আলামত মিলেছে। বিলম্বে মামলা দায়ের, আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি সচেতনতার অভাবকে এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে ধর্ষকরা।
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই বছরে শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে ৬৯৩ জন নারী ও শিশুকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন থানা ও আদালত থেকে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে ৬৭২ জন নারী এবং ২১ জন শিশু। এসব পরীক্ষায় ধর্ষণচেষ্টার ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছে মাত্র ৩৮ জন নারী। বাকিদের ধর্ষণের কোনো প্রমাণ মেলেনি। ফলে ধর্ষণের অভিযোগ করেও ডাক্তারি পরীক্ষার জবাব পেয়েছে ‘না’ সূচক।
শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান এ বি রেফায়েতুল হায়দার বলেন, আমাদের কাছে যেসব ভিকটিম আসে, তাদের মধ্যে ২০২৪ সালে ৩১৫ জন এবং ২০২৩ সালে ৩৭৮ জনকে সেবা দিয়েছি। আমরা তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের মধ্যে শতকরা তিন থেকে ৫ ভাগের শরীরে ধর্ষণচেষ্টার আলামত পেয়েছি। কিন্তু কারও মধ্যেই ধর্ষণের প্রমাণ পাইনি।
হাসপাতালের ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের মতে, বিলম্বের কারণে আলামত নষ্ট হওয়ায় এমনটা হয়েছে। তাদের মতে ক্ষতিগ্রস্ত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত উভয়কেই দ্রুততার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সচেতন হতে হবে।
শেবাচিমের উপ-পরিচালক এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, আমাদের হাসপাতাল ও ওসিসিতে অধিকাংশ ধর্ষণ মামলা প্রমাণিত হচ্ছে না। এর কারণ হলো সম্ভবত এরা দেরি করে আসছে। ধর্ষণের শিকার যারা, তাদের কাছ থেকে যে আলামত সংগ্রহ করা হয়, তা এখানে আসতে আসতেই নষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ধোয়ামোছা, গোসল ও কাপড় পরিবর্তন না করার যে উচিতকাজ তা তারা করেন না। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত এবং আইনি সহায়ক উভয়কে দ্রুততার সঙ্গে সব মেনে চলতে হবে। ওসিসিতেও দ্রুত আসতে হবে।
একেতো ডাক্তারি পরীক্ষা হচ্ছে বিলম্বে, এর সাথে রিপোর্ট নেতিবাচক, অন্যদিকে রিপোর্ট প্রাপ্তি ও মামলার দীর্ঘসূত্রতা নিয়েও নাজেহাল হয়েছেন এমন সব মামলার বাদীরা। তাদের মতে ধর্ষণের বিচার প্রাপ্তি সহজতর নয়।
একজন নারী বিচার প্রার্থী বলেন, তালাক দেওয়ার পরও আমার স্বামী আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমার মামলা করতে দুই মাস সময় লেগেছে। এরপর স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট গত চার মাসেও হাতে পাচ্ছি না। আমার সাবেক স্বামী জামিনে মুক্ত হয়ে গেছে। আর আমি ঘুরতেই আছি।
অপর এক পুরুষ বিচার প্রার্থী বলেন, আমার মেডিক্যাল রিপোর্ট পেতে ছয় মাস দেরি হলো। এদিকে আসামি জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে। থানা পুলিশ এই রিপোর্ট পেতে দেরি করে। ওরাই আসামিকে পালানোর সুযোগ করে দেয়।
এসব ঘটনায় বিপরীত অবস্থানে রয়েছে আইন ও পুলিশ বিভাগ। আইনজ্ঞরা এতসব বিলম্বের জন্য পুলিশকে দায়ী করছেন। তাদের মতে বিলম্বের কারণে নেতিবাচক মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে দোষীদের শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না। তাদের মতে ধর্ষণের নেতিবাচক রিপোর্ট হাতে আসার পর বিচার প্রার্থনার পথ অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বরিশাল আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, ধর্ষণ মামলাগুলো প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে বেশি হচ্ছে। এসব মামলায় ২০-২৫ দিন বিলম্ব হয়ে যায়। তখন এটি মেডিক্যাল পরীক্ষায় গেলে আলামত আর মেলে না। এ ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার গাফলতি আছে। ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষিতার মেডিক্যাল টেস্ট করানোর নিয়ম থাকলেও কিন্তু পুলিশ তা করে না। এর জন্যই মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো ফেইল করছে। অথচ একটি ধর্ষণ মামলায় ইতিবাচক মেডিক্যাল রিপোর্ট অত্যাবশ্যকীয়। এ ছাড়া ধর্ষককে শাস্তি দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। এটা আসলে তদন্তের ব্যর্থতা। এত বড় একটা অমানবিকতার শিকার নারীকে মেডিক্যাল রিপোর্টের কারণে আমরা আইনি সহায়তা দিতে পারছি না।
নারীদের আইনি সহায়তাকারীদের মতে, দীর্ঘসময় মামলা লড়াই করার পর যখন দেখা যায় মেডিক্যাল রিপোর্টে ধর্ষণ প্রমাণিত হয়নি, তখন হাল ছেড়ে বসে থাকতে হয়।
নারী উদ্যোক্তা জাহানারা স্বপ্না বলেন, আমরা নারীদের নিয়ে কাজ করি। এখানে দুই বছরে কোনো ধর্ষণ হয়নি, এটা আমি মানি না। ধর্ষণ হওয়া থেকে শুরু করে মামলা দায়ের এবং ডাক্তারি রিপোর্ট পর্যন্ত নারীরা পদে পদে নির্যাতিত হচ্ছেন। আমি মেডিক্যাল রিপোর্টের এই তথ্য মানি না। মেডিক্যালে আলাদাভাবে ভিকটিমদের জন্য বিভাগ খোলা উচিত। ধর্ষণ প্রমাণিত না হওয়ার মধ্যে দুর্নীতি আছে। নারীরা যাতে নিজেরা নিজেদের পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে মামলা করতে যেতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ জাকির হোসেন তালুকদার বলেন, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের আমলা আমাদের কাছে এলেই আমরা যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। অনেক সময় দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্তরাই বিলম্ব করছে। সেক্ষেত্রে আলামত নষ্ট হয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রে আলামত ও মেডিক্যাল রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়ে থাকি। সবকিছু সমন্বয় করেই এ প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এক কথায় ধর্ষণের অভিযোগ পর্যন্ত থাকছে সব প্রক্রিয়া। একমাত্র ডাক্তারি পরীক্ষার নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বলতে গেলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধর্ষকরা।